রোহিঙ্গাদের সহায়তায় অন্তর্বর্তী সরকারের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না আন্তর্জাতিক দাতারা

এফএনএস এক্সক্লুসিভ | প্রকাশ: ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৮:০৯ এএম
রোহিঙ্গাদের সহায়তায় অন্তর্বর্তী সরকারের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না আন্তর্জাতিক দাতারা

বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক দাতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ডাকে আশানুরূপ সাড়া দিচ্ছে না। বরং চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য মিলেছে চাহিদার অর্ধেকেরও কম আন্তর্জাতিক সহায়তা। আর আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, আশ্রয় ও শিক্ষাসহ প্রায় সব মানবিক খাতে। সহায়তা এভাবে কমতে থাকলে শিগগিরই রোহিঙ্গা সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য বড় ঝুঁকি। দাতা সংস্থাগুলো যদি দ্রুত সাহায্য বাড়াতে না পারে তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীেেক একেবারে অসহায় অবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সামনে দাঁড়াতে হবে। আর সহায়তার হার নিম্নগামী হতেই রোহিঙ্গাদের খাবার, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনীয়তার নিশ্চয়তা থাকবে না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কর্মরত এনজিও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বর্তমানে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় এখন শুধু খাদ্য বা চিকিৎসাসেবার ঘাটতিতে নয়, বরং পুরো জনগোষ্ঠী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংকটে পড়েছে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় ২০২৫ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের আওতায় মোট ৯৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার সহায়তার প্রয়োজন হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার পাওয়া গেছে। যা প্রয়োজনের মাত্র ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সহায়তার অর্ধেকেরও বেশি  এখনো ঘাটতি রয়েছে। আর ২০২৪ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের আওতায় রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজন ছিল ৮৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার। কিন্তু পুরো বছরে পাওয়া যায় মাত্র ৫৪ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। যা মোট প্রয়োজনের ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছরও আন্তর্জাতিক সহায়তা বেশ কমেছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রায় ১২ লাখের বসবাস। কক্সবাজার ও ভাসানচরের আশ্রয় শিবিরে তারা মূলত শরণার্থী জীবনযাপন করছে। তাদের খাদ্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সহায়তা থেকে আসে। কিন্তু ওই সহায়তা কমে আসায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো জটিল মানবিক সংকটে পড়েছে এখন। বর্তমানে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে মানবিক সহায়তা কমে এসেছে। অনেক দাতা সংস্থাই সরে যাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা শিবিরে বাজেট কাটছাঁট চলছে খাবার, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আশ্রয় সবকিছুর ওপরই। মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন শিশুদের দুধ, টয়লেট পরিষ্কার রাখার উপকরণ, এমনকি ওষুধও নিয়মিতভাবে আসছে না। যদিও চলতি বছর মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চে রোহিঙ্গা সমস্যাকে জোরালোভাবে তুলে ধরা। তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পও পরিদর্শন করেছেন। তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তাছাড়া সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদ হলে উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। সম্মেলনে অন্তত ৭৫টি দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছিল। তাছাড়া বিভিন্ন সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্তর্বতী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্লাটফর্মে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও মানবিক সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ডাকে আন্তর্জাতিক দাতারা সাড়া দিচ্ছে না। বরং চলতি বছর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য চাহিদার অর্ধেকেরও কম আন্তর্জাতিক সহায়তা মিলেছে।

সূত্র আরো জানায়, প্রয়োজনীয় তহবিলের ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ায় এরই মধ্যে চলতি বছর ফলে অনেক খাতে সেবা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেকগুলো স্বাস্থ্য কেন্দ্র বন্ধ অথবা সীমিত সেবা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রসূতিসেবা, অপারেশন, শিশুর জরুরি চিকিৎসা প্রতিটি ক্ষেত্রে সংকট চলছে। ক্যাম্প ১৫-এর ইউনিসেফ পুষ্টি কেন্দ্রে প্রতিদিন ৩০০ শিশুকে গুরুতর অপুষ্টির পরীক্ষা করতে হচ্ছে, আর গত বছর থেকে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা বেড়েছে ১১ শতাংশ। নবজাতকরা জন্ম নিচ্ছে এমন পরিবেশে যেখানে স্যালাইন, ভিটামিন এ, রেডি টু ইউস থেরাপিউটিক ফুড সব কিছুরই সংকট। শুধু শিশুরাই নয়, গর্ভবতী নারীদের অবস্থাও খারাপ। রেশন কমে যাওয়ায় অনেক পরিবারের নিয়মিত খাবার এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। মায়েরা প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার পাচ্ছে না, এমনকি নিরাপদ প্রসবের উপকরণও নেই। যার ফলে কম ওজন নিয়ে জন্মানো নবজাতকের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক শিশু জন্মের প্রথম সপ্তাহ থেকেই গুরুতর পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে পড়ছে। তাছাড়া শুধু খাদ্য বা স্বাস্থ্য নয়, আশ্রয় শিবিরের প্রতিদিনের জীবনচক্রও সংকটে। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাব দেখা দিয়েছে। অনেক জায়গায় সাবান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ন্যূনতম উপকরণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ত্রিপলুও বাঁশের অস্থায়ী ঘরগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, ঘূর্ণিঝড় বা বৃষ্টিতে সেগুলো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে। শিক্ষা খাতেও কাটছাঁট হওয়ায় কমিউনিটিভিত্তিক শেখার সুযোগ কমছে। তহবিল না বাড়লে সামনে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যার প্রভাব শুধু রোহিঙ্গাদের ওপর নয়, কক্সবাজার অঞ্চল ও স্থানীয় অর্থনীতির ওপরও পড়বে।

এদিকে মানবিক সহায়তার নিম্নমুখিতা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় দাতারা সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সহায়তা তুলনামূলকভাবে আরো কমে আসবে। তখন ২০১৭ সালের আগের মতো সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকবে। বিশ্ব ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা ইস্যু ভুলে যাবে এটাই সবচেয়ে বড় ভয়। এতে শুধু আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগই বাড়বে না, বরং তাদের ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও বাড়বে। কারণ এর মধ্যেই নতুন করে রোহিঙ্গাদের আগমন পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। প্রথম এবং সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ঝুঁকি হলো অর্থনৈতিক চাপ, যেটা বাংলাদেশের ওপর বাড়বে। তাছাড়া বেঁচে থাকার তাগিদে রোহিঙ্গারা অনির্ধারিত কাজের দিকে ঝুঁকবে, শিবিরের বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা বাড়বে। চোরাচালান ও মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আরো বড় উদ্বেগ হলো উগ্রপন্থার ঝুঁকি। সহায়তা কমে গেলে এবং হতাশা বাড়লে রোহিঙ্গা তরুণদের একটি অংশ উগ্র বা সহিংস গোষ্ঠীর প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হয়ে উঠতে পারে।