পরিযায়ী পাখির সুরক্ষা দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব

প্রকাশ ঘোষ বিধান | প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৩:১৮ পিএম
পরিযায়ী পাখির সুরক্ষা দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব
প্রকাশ ঘোষ বিধান

পাখি হলো পালক ও পাখাবিশিষ্ট দ্বিপদী প্রাণী। জীবিত পাখিদের মধ্যে মৌ হামিংবার্ড সবচেয়ে ছোট আর উটপাখি সবচেয়ে বড়ো। পৃথিবীতে প্রায় দশ হাজার পাখির প্রজাতি রয়েছে। পাখিদের মধ্যে অনেকেই পরিযায়ী। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এরা বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই পাখিরা বিস্তৃত, অর্থাৎ সাতটি মহাদেশের সবখানেই পাখি দেখা যায়। 

পরিযায়ী পাখি প্রকৃতি ও পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিযায়ী পাখিকে পরিব্রাজক বা যাযাবর পাখিও বলা হয়। পরিযায়ী পাখি বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি, যারা শীতের সময় বহু পথ পেরিয়ে আমাদের দেশে আসে এবং কিছুদিন অবস্থান করে। 

পাখি পরিযাণ বলতে নিদিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির প্রতি বছর বা কয়েক বছর পর পর একটি নিদিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে কম করে দুটি স্থানের মধ্যে আসা-যাওয়াকে বোঝায়। যে-সব প্রজাতির পাখি আসা- যাওয়ায় অংশ নেয়, তাদেরকে পরিযায়ী পাখি বলে। এ পাখিরা প্রায় প্রতি বছর পৃথিবীর কোনো এক বা একাধিক দেশ থেকে বিশ্বের অন্য কোনো দেশে চলে যায় কোনো একটি বিশেষ ঋতুতে। ঋতু শেষে আবার সেখান থেকে ফিরে আসে। এ ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতি বছর এবং কমবেশি একই সময়ে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, পরিযায়ী প্রজাতি অর্থ ওই সব বন্যপ্রাণী, যারা এক বা একাধিক দেশের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় আসা-যাওয়া করে থাকে। 

পৃথিবীতে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার প্রজাতির পাখি আছে, তার এক-তৃতীয়াংশই পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশে ৭০০ এর অধিক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। 

পরিযায়ী পাখিদেরকে আগে অতিথি পাখি বলা হতো। কিন্তু নিবিড় গবেষণায় দেখা গেছে যে এরা অতিথি নয়। বরং যে দেশে যায় সেখানে তারা ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত বাস করে। অর্থাৎ বছরের বেশ কয়েকমাস তারা ভিনদেশে বাস করে নিজ দেশে তারা বাস করে স্বল্প সময়ের জন্য। 

পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। পরিযায়ী পাখিগুলো আমাদের দেশে বিল, ঝিল, হাওর, বাঁওড়, হ্রদ, নদ, নদী, সাগর ও জলাভূমিতে আশ্রয় নেয় ও বাস করে থাকে। এরা সাধারণত রাতের বেলা অন্ধকারে দলবেঁধে পরিযায়ন করে। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, এরা মূলত শিকারি পাখিদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে রাতের অন্ধকারে পরিযায়ন করে। কিন্তু মানুষ রুপি শিকারির হাত থেকে এরা রেহাই পাচ্ছে না। 

আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের ধারণা, পরিযায়ী পাখি মূলত মাছ খেয়ে জীবনধারণ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরিযায়ী পাখিরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ, ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ ও পোকামাকড়, শামুক, ব্যাঙাচি, জলজ গুল্ম, শ্যাওলা ইত্যাদি খেয়েও জীবনধারণ করে। কিছু পরিযায়ী পাখি ছোট মাছ খেয়ে থাকে। 

দেশে প্রতি বছর শীতের মৌসুমে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিযায়ী পাখিদের ভূমিকা অপরিসীম। পরিযায়ী পাখিরা শুধুমাত্র নিজেদের প্রশান্তির জন্যই আমাদের দেশে আসে না। আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসা এসব পাখি নানাভাবে আমাদের উপকারও করে চলেছে প্রতিনিয়ত। শীতে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে শিকারিদের তৎপরতাও বেড়ে যায়। এ দেশের একশ্রেণীর মানুষ অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য পরিযায়ী পাখি শিকার করে। অনেক শিকারিরা বিক্রির জন্য বিষটোপ, পাখির নকল শব্দের ফাঁদ, জালের ফাঁদ ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে পরিযায়ী পাখি শিকার করে থাকে। শৌখিন শিকারিদের উদ্দেশ্যে মাংস খাওয়া এবং ক্ষমতা ও আভিজাত্যর বহিঃপ্রকাশ, আর অন্যান্য শিকারিরা লোভের বশে স্বল্প পরিশ্রমে বেশি আয় করা। 

বাংলাদেশ সরকার পরিযায়ী পাখি/বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ প্রণয়ন করেছেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে পরিযায়ী পাখি শিকার ও বিক্রয় দণ্ডনীয় অপরাধ। সেই আইনের ধারা ৩৮ এর (১ ও ২) অনুযায়ী পরিযায়ী পাখিকে আঘাত করা, দখলে রাখা, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মাংস ভক্ষণ, এয়ারগান দিয়ে শিকার, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ধরা, প্রজননের সময় বিরক্ত, ডিম নষ্ট ও হত্যা করা ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক লাখ টাকা জরিমানা, এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণ। কিন্তু আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে এই মৌসুমে পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এর ফলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনেও ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। 

আমরা গভীরভাবে কখনোই উপলব্ধি করি না, কিন্তু পরিযায়ী পাখি পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্য অনবদ্য অবদান রেখে চলছে প্রতিনিয়ত। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় নিধন করে। পরিযায়ী পাখি ফুল ও শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শীতের সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির আগমনে নৈসর্গিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠা জমিতে পড়ার ফলে জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধি পায়। জমিতে নাইট্রোজেনের আবির্ভাব ঘটিয়ে জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

পরিযায়ী পাখি পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠায় মাছের খাবার তৈরি হয়, ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া, পরিযায়ী পাখির দৈহিক সৌন্দর্য, আকাশে উড়ার দৃশ্য, বৈচিত্র্যময় জীবনাচরণ মানুষকে বিনোদন দেয়। 

বর্তমান বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তনের ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে পরিযায়ী পাখিরা মারাত্মক খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। জলাভূমি, বনভূমি, তৃণভূমি এবং উপকূলীয় অঞ্চল-এসব প্রাকৃতিক আবাসস্থল পরিযায়ী পাখিদের বিশ্রাম, খাদ্য সংগ্রহ এবং সাময়িক আশ্রয় দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মানুষের অসচেতনতা এবং পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তনের কারণে এই মূল্যবান আবাসস্থলগুলো আজ হুমকির মুখে। 

পরিযায়ী পাখিরা কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, তারা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে ফসল রক্ষা করে, ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে এবং বীজের বিস্তারে ভূমিকা রাখে। পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া পরিবেশের জন্য একটি অশনি সংকেত। এটি জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং খাদ্যশৃঙ্খলের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। 

বর্তমান বিশ্বের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলকে নিরাপদ রাখা ও পাখিদের বিচরণস্থল সংরক্ষণ করা সকলের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই প্রকৃতির অলংকার, বাস্তুতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী, প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ পাখিকে রক্ষা করতে পারবে। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর সুস্থ বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত হবে। 

লেখক: প্রকাশ ঘোষ বিধান; সাংবাদিক ও কলামিস্ট