আজ ১৫ ডিসেম্বর পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত দিবস

এফএনএস (সোহেল সানী; পার্বতীপুর, দিনাজপুর) : | প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০১:০৬ পিএম
আজ ১৫ ডিসেম্বর পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত দিবস

১৪ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর যৌথ হামলায় পাকসেনা, রাজাকার ও অবাঙালীরা বিশেষ ট্রেনযোগে পার্বতীপুর ত্যাগ করে সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। ট্রেনে স্থান না পেয়ে অনেকেই রেললাইন ধরে দল বেঁধে রওয়ানা হয়। সেই মুহূর্ত থেকে এই জনপদ হানাদারমুক্ত হয়। ১৫ ডিসেম্বর রাত ১২টার পরে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিকামী হাজার হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পার্বতীপুর শহরে প্রবেশ করতে থাকে। পরের দিন ১৬ ডিসেম্বর দুপুর পর্যন্ত এই শহর পরিণত হয় জনসমুদ্রে। আকাশের দিকে রাইফেলের ফাঁকা ফায়ারে কানপাতা যায় না। শহরের ঘরবাড়ী, দোকানপাটে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এই জনপদে যে গণহত্যা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর সারা দেশের মত দিনাজপুরের পার্বতীপুরেও শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস-আদালত স্কুল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। প্রায় বন্ধ হয়ে যায় রেল যোগাযোগ। মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর প্রতিরোধের মুখে পাকহানাদার বাহিনীরা পার্বতীপুর এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। ফলে ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রচন্ড মুক্তিযুদ্ধের পর দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। ২৩ মার্চ এ শহরে অবাঙ্গালীদের বৈষম্যমূলক আচরনে ক্ষুদ্ধ হয়ে পার্বতীপুরের গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ শহর ঘেরাও করে সিদ্দিক মহল্লায় অগ্নিসংযোগ করে। এসময় অবাঙ্গীলীরা নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর ব্যাপক গুলি বর্ষনে কালাই ঘাটির রইচ উদ্দিন, আটরাই গ্রামের দুখু, বেলাইচন্ডির মোজাম্মেল হক ও শফি প্রমুখ প্রাণ হারায়। উল্লেখ্য, ২৪ ও ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী ইমাম মোল্লাসহ ১১জন, এম আহাম্মেদের ৪ জন কর্মচারী, কাশিয়া তৈরীর পরিারের ৪ জন সদস্য, পার্বতীপুর থানার এএসআই গোলাম এর পরিবারের সকল সদস্য, ক্যাপটেন ডাক্তারের পুত্র শামসাদকে হাবড়া ইউনিয়নের ভবানীপুর থেকে আঃ হাকিমকে কয়লার ব্রয়লারে জীবন্ত নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে হত্যা করে। এ গণহত্যার পর বাঙ্গালীরা ক্রোধে ফেটে পড়ে। ২৮ মার্চ একজন পাঞ্জাবী মেজরের অধীনে কয়েকজন বাঙ্গালী সৈন্য হুগলী পাড়ায় সিও অফিস চত্বরে পাহারা দিচ্ছিল। দ্বিতল ভবনে কামান পেতে মেজর বাঙ্গালীদেরে তৎপরতা লক্ষ্য করে। ওয়ারলেসে খবর দেয়ার চেষ্টা করলে বাঙ্গালী সৈন্যের সাথে তর্ক বিতর্ক হওয়ায় তাকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় জানতে পেরে হুগলী পাড়ার ছাত্র আব্দুল লতিফকে নির্মমভাবে হত্যার পর জলন্ত ব্রয়লারে পুড়িয়ে ফেলে। ২৯ মার্চ শহরের পুরাতন বাজারের উপেন চন্দ্রশীল ও সুভাষ চন্দ্র শীলসহ ১৪ জনকে নির্মমমভাবে হত্যাকরে লাশগুলো বাড়ীর একটি কুয়া (ইন্দিরা)র মধ্যে ফেলে দেয়। ১ এপ্রিল সংগ্রামী যুবক দল বৃত্তি পাড়ার নিকট মর্টার বসিয়ে সন্ধায় একযোগে চতুর্মূখী আক্রমনে চালায়। শেষ রাতে হঠাৎ কামান গর্জে উঠে ও তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। পার্বতীপুরে প্রথম সেল নিক্ষিপ্ত হয় শহরের সোয়েব বিল্ডিংয়ের উপর। ২ এপ্রিল পাকসেনা ও অবাঙ্গালীরা হিংস্রতায় উম্মুক্ত হয়ে পার্বতীপুরের ৫বর্গ কিলোমিটার জনপদে অগ্নিসংযোগ, লুট,হত্যা, ধর্ষন ও নির্যাতন চালায়। তারা রামপুরা গ্রামের একান উদ্দিন, ভেদলু, ব্রক্ষোত্তরের হবিবর রহমান, তাজনগর ডাঙ্গা পাড়ার আঃ আজিজ, হুগলী পাড়ার তালাচাবী তৈরীর মিস্ত্রি আব্দুর রহমান ও সোবহানকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং নারীদের উপর নির্যাতর চালায়। ৮ এপ্রিল সবচেয়ে বৃহৎ গণহত্যার ঘটনা ঘটায় পাকসেনারা। রংপুর থেকে পাকসেনারা ট্রেনে করে এসে বদরগঞ্জে পশ্চিমে ব্রীজের কাছে নামে। এদিকে, পার্বতীপুর শহরের অবাঙ্গীলীদের নেতা বাচ্চা খানের নেতৃত্বে একটি সামরিক গাড়ীও যায় খোলাহাটিতে। বিকেল ৩টায় দিকে পাকসেনারা আক্রমন চালিয়ে শিশুসহ প্রায় ৩শ’ নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। সংগ্রামী যুবকরা ভারতের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিংএ অংশ নেয়। ট্রেনিং শেষে পার্বতীপুরে কৃতি সন্তান মোঃ জালাল উদ্দিন ‘ই’ কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে ৪০ জনের মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে প্রথম বাংলাদেশে প্রবেশ করে। জুলাইয়ের প্রথম দিকে ফুলবাড়ী ভেরম নামক স্থানে ‘বেস’ ক্যাম্প স্থাপন করেন। ভেরমের ৫ কিলোমিটার পূর্বে পাকসেনাদের ‘চিন্তামন ক্যাম্প’ ও ৩ কিলোমিটার উত্তরে পাকসেনাদের জলপাইতলী ক্যাম্পে ঘাটি ছিল। ‘বেস ক্যাম্প’ স্থাপনের ৫ দিনের মাথায় পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনা মারা যায়। ৭দিন পরে দু’দফা যুদ্ধ বেঁধে যায়। এবারও ৭জন পাক সেনা মারা যায় এবং চিরিরবন্দরের মোজাফ্ফর হোসেন ও খাগড়া বন্দের তাহের নামে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। খয়রাত হোসেন নামে অপর এক মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি করে পাকসেনারা নিয়ে যায়। এছাড়াও আমজাদ হোসেন নামে এক মুক্তিযোদ্ধা গুলিতে আহত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনে দুটি ক্যাম্পের পাক সেনারা একত্রিত হয়ে ৭ দিন পর ৩য় দফা সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজয় বরন করে সেখান থেকে পালিয়ে যায় কিন্ত তাদের গুলিতে তাজনগরের আব্দুল মজিদ নামের এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে, হরিরামপুর ইউনিয়নের পূর্ব হোসেনপুর গ্রামের আজিজার রহমান চৌধুরী ও তার ভাই মতিয়ার রহমান একই সাথে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। চাঁচেয়া গ্রামের সহির উদ্দিন, দলাইকোঠা গ্রামের মোঃ শাহাবুদ্দিনকে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকসেনারা এবং পরদিন খয়েরপুকুর হাটের কাছে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ‘ই’ কোম্পানি পার্বতীপুরের হামিদপুর পাটিকাঘাট আনন্দবাজার নামক স্থানে গ্যারিলা ক্যাম্প স্থাপন করে। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ভ্যালাগাছির রেল ব্রীজের কাছে পাহারারত পাক হানাদের উপর আক্রমন চালায়। পরে ভবানীপুর শাহগ্রাম রেল ব্রীজটি আক্রমন করে ১৬ জন রাজাকারকে আটক করে এবং ব্রীজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ায় ৭ দিন ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। ক্রমান্নয়ে ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে এসে পাকসেনাদের উপর বিভিন্ন দিকে থেকে আক্রমন চালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পার্বতীপুর এলাকা থেকে আজ ১৫ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীরা পালিয়ে গেলে পার্বতীপুর শত্রু মুক্ত হয়।  

মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি স্বরূপ পার্বতীপুরে রেল স্টেশনের উত্তর দিকে ‘৭১ এর গণকবর এর পার্শে পরে পার্বতীপুরের সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার কল্লোল কুমার চক্রবর্তীর উদ্যোগে ও স্থানীয় সুধীজনের সহযোগিতায় বধ্যভূমি স্মৃতি সৌধ’ নির্মান করা হয়। আজ ১৫ ডিসেম্বর পার্বতীপুরবাসী ‘বধ্যভূমি স্মৃতি সৌধে’ পুস্পস্তবক অর্পনের মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত দিবস পালিত হয় থাকে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে