কালের বির্বতনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে জমিদারি প্রথা। হারিয়ে গেছে জমিদারদের প্রতাপ কিন্তু মুছে যায়নি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তেমনই ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের দত্তপাড়া গ্রামে অবস্থিত ২৪টি দালানের ঐতিহাসিক সাতানি জমিদার বাড়ি। যারমধ্যে দুটি দালান নবাব আলিবর্দি খানের সময়কার (১৭৪১ সালের) বর্গি আমলের।
প্রাচীণ স্থাপত্যশৈলী ও শৈল্পিক কারুকাজের জমিদার বাড়িটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে অযত্ন অবহেলায় ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সাতানি জমিদার বাড়িটি যুগ-যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে জমিদার বাড়িটি একনজর দেখতে আসেন বহু পর্যটক। তবে তারা ঝোপ জঙ্গলে ঘেরা ভূতের বাড়িখ্যাত ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িতে এসে নিরাশ হচ্ছেন। অথচ এ জমিদার বাড়িটি সংস্কারের মাধ্যমে হতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র।
সাতানি জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশের এক সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক নিদর্শন। কালের সাক্ষী এই জমিদার বাড়িটি শুধু পুরনো ভবন নয়; এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের এক অনন্য প্রতীক। বরিশালের পশ্চিমে বানারীপাড়া উপজেলায় মায়াবী সন্ধ্যা নদী অবস্থিত। সন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী স্থানেই সাতআনি (সাতানি) জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। স্থানীয় বাসিন্দারা ওই বাড়িটিকে সাতানি মন্দির বাড়ি হিসেবে চিনে, আবার অনেকে দত্তপাড়া জমিদার বাড়ি হিসেবেও চিনে থাকেন।
প্রায় ২২ একরের জমিদার বাড়িটিতে মোট ২৪টি দালান রয়েছে। নবার আলিবর্দি খানের সময়কার (১৭৪১ সালে) এতদাঞ্চলে বর্গীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ওই বাড়িতে দুইটি আকর্ষণীয় দালান নির্মাণ করা হয়েছিল। দালান দুইটিতে একটি দরজা ও দুইটি জানালা দেখা যায়। যা থেকে বরিশালের ইতিহাসবিদগণ ধারনা করছেন ওই জমিদার বাড়িটি ২৮৪ বছরেরও অধিক সময়ের পুরনো। তবে এখানে কোন জমিদার বসবাস করেছেন তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ওই বাড়িতে বালাখানা নামে একটি দালান রয়েছে। জমিদারের নায়েবরা বসতেন সেই বালাখানায়। ২৪টি দালানের মধ্যে কয়েকটি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
আশ্চর্যজনক হলেও ওই বাড়ির একটি মন্দিরে একসাথে তিনটি দুর্গাপূজার আয়োজন করা হতো। মহিষ বলিদান হতো এবং পরে মহিষের পরিবর্তে ভোগ দেওয়া হতো। এছাড়া নারায়ন ও মনসা মন্দির ছিলো জমিদার বাড়িতে। দুর্গাপূজার সময় ওই বাড়িতে যাত্রা, থিয়েটারসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এখনও সেখানে ঐতিহ্য ধারণ করে পালন করা হয় সাতানির পার্শ্ববর্তী মন্দিরে ১০ হাত লম্বা কালীমাতার কালী পূজা। জমিদারদের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকভাবে কোন তথ্য দিতে পারেননি স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা।
দত্তপাড়া সাতানি জমিদার বাড়ি আসার জন্য ব্রিজ পাড় হতেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহমরণ সমাধিক্ষেত্র (স্বামীর মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় বা চাঁপে পড়ে স্ত্রী চিতায় আত্মাহুতি দিতেন, যা সতীদাহ নামে পরিচিত ছিল)। যা ভারতবর্ষের সহমরণ প্রথার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সূত্রমতে, সাতানিতে একটি পঞ্চম শ্রেণির স্কুল ছিল। ইন্দির আইচ নামের একজন নামকরা পন্ডিত সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। ওই স্কুলে নিমাচাঁদ চক্রবর্তী শিক্ষকতা করতেন। ধর্ম খানের বংশের উত্তরসূরি মতিলাল ভৌমিক এ অঞ্চলের আলো ছড়ানো বিদ্যাপিঠ বাইশারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনারারি (বেতন নিতেন না) শিক্ষক ছিলেন। ভীম ভৌমিক ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত খোলবাদক ছিলেন। সেবার ব্রত নিয়ে সুনামের সাথে কাজ করেছেন ভীম ভৌমিকের উত্তরসূরী ডা. লক্ষীকান্ত ভৌমিক ও তার সহকর্মী ডা. সূর্য কান্ত সাহা। ডা. সূর্য কান্ত সাহার ছেলে ডা. উত্তম কুমার সাহা বর্তমানে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ডা. উত্তম কুমার সাহা বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষদের অনেকে মারা গেছেন। কেউ ভারতবর্ষে, কেউ ঢাকায় নানাদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বহু বছর পূর্বে জমিদার বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সবুর মেম্বার লিজ নিয়ে সাতানি জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য গাছ-গাছালি কেটে নিয়ে গেছেন। ডা. উত্তম কুমার সাহার কাকা শহীদ সৈনিক আদিত্য সাহার সমাধি রয়েছে ওই জমিদার বাড়িতে। যিনি শান্তি বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে বান্দরবনের রামুতে শহীদ হন। বেদখলের কারণে সমাধী মন্দিরটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। উত্তম সাহা সরকারের কাছে দাবি করে বলেন, আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যবাহী এই জমিদার বাড়ির অর্পিত বা দখলকৃত সম্পত্তি যেনো মূল মালিকদের প্রত্যর্পণ (ফিরিয়ে দেয়া) করা হয় এবং সরকার যদি লিজ দেয়, তাহলে যেন আসল মালিকদের কাছে লিজ দেওয়া হয়।
২৭ বার কারাবরণকারী বিপ্লবী কুমুদ বিহারী গুহ ঠাকুরতা প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সার্বজনীন মন্দিরের সভাপতি দেবাশীষ দাস বলেন, সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের বানারীপাড়া মূলত সমৃদ্ধ হয়েছিল এসব ঐতিহ্যবাহী বাড়ি এবং তাদের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের কর্মকান্ডের জন্য। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এসব বাড়ির উত্তরাধিকারদের একটু করে হলেও শিখরের সাথে সংযুক্ত থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি।
স্থানীয় বাসিন্দা বরিশাল বেতারের ঘোষক, বাচিক শিল্পী, শিক্ষক ও প্রবন্ধকার বিশ্বনাথ রায় বলেন, দত্তপাড়া জমিদার বাড়িটি ঐতিহাসিক নিদর্শন স্বরূপ। এই অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণ সময়ের দাবি। একসময়ের ঘণবসতিপূর্ণ বাড়িটি আজ নীরব। চামচিকা, সাপ, কাঠবিড়ালি, বেজি ও পোকামাকড়সহ বড় বড় লতা-গাছ-গুল্ম ও ঘণ জঙ্গলকে ধারণ করে দালানগুলো অযত্ন অবহেলায় ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।