ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) সংসদীয় আসনে প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ এখন দৃশ্যমান। লিফলেট বিতরণ, পথসভা, উঠান বৈঠক ও গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন মনোনয়নপ্রাপ্ত ও প্রত্যাশীরা।
তবে বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ ১৮ বছরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই এবারের নির্বাচনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বরিশালের বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৩ আসনটি মুলাদীর একটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়ন এবং বাবুগঞ্জের ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এই আসনটি ঐতিহ্যগতভাবে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমানের বিপক্ষে একই দলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। এতে বিভক্ত ভোটের কারণে পরাজিত হন দলীয় প্রার্থী বেগম সেলিমা রহমান। সেই সময় সৃষ্ট বিভক্তি আজও নিরসন না হওয়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখানে কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে রয়েছেন।
এই দুই হেভিওয়েট নেতার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। একাধিকবার একই দিনে একই এলাকায় পৃথক কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে তাদের অনুসারীদের। ফলে সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে-কাকে অনুসরণ করবেন, কোন পথে এগোবেন?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেড় দশকের বেশি সময় ধরে চলমান এই অমীমাংসিত বিরোধ এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গত ৪ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত বরিশাল-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। এতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ আসনে আরেক হেভিওয়েট মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান। দুই নেতার প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত জয়নুল আবেদীনের ওপর আস্থা রাখে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, অনুন্নত বাবুগঞ্জ-মুলাদীকে একটি আধুনিক ও উন্নত জনপদে রূপান্তর করাই আমার মূল লক্ষ্য। এ অঞ্চলকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তবে এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন মুলাদী উপজেলার সাবেক পৌর মেয়র ও জেলা বিএনপির সদস্য আব্দুস সাত্তার খানও। মনোনয়ন না পাওয়ার পর ঘোষণার দুই দিন পর তার অনুসারীরা মুলাদী উপজেলায় সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি জানান। এতে বিএনপির একটি অংশকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
একইভাবে বাবুগঞ্জ উপজেলায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমানের মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে মশাল মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। গত ১৫ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় এই কর্মসূচি পালন করেন মনোনয়নবঞ্চিত নেত্রীর অনুসারী বাবুগঞ্জ বিএনপির একটি অংশ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গত ১৭ বছরে বরিশাল-৩ আসনে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, মাদক, কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এলাকাবাসী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এখন যদি যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে সামনে আনা না যায়, তবে তা এই আসনের মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হবে।
বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ খান বলেন, দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আমরা এখন আরও সংগঠিত ও উজ্জীবিত। অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে নির্বাচনী মাঠে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলব।
অন্যদিকে, সাবেক উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইসরাত হোসেন কচি অভিযোগ করে বলেন, “বিগত ১৭ বছর রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়ে হামলা-মামলা ও কারাবরণকারী ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করে বাবুগঞ্জের ছয়টি ইউনিয়নে বিতর্কিত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে তৃণমূলের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এদিকে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও ইতোমধ্যে মাঠে সক্রিয় প্রচারণায় নেমেছে। এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যক্ষ জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর এবং আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদও প্রচারণা চালাচ্ছেন।