বিদায় নয়, হাদি চিরদিন থাকবে মানুষের বুকের ভেতর: জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক
| আপডেট: ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১১:৫২ পিএম | প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৬:২২ পিএম
বিদায় নয়, হাদি চিরদিন থাকবে মানুষের বুকের ভেতর: জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা

শহীদ শরিফ ওসমান হাদির জানাজা পরিণত হলো শোকের পাশাপাশি অঙ্গীকারের মহাসমাবেশে। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় লাখো মানুষের সামনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্ট করে বললেন, হাদিকে বিদায় জানাতে মানুষ জড়ো হয়নি, বরং তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়নের ওয়াদা করতেই সবাই এক হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন হাদি সব বাংলাদেশির বুকের ভেতরেই থাকবে।

শনিবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরের পর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শহীদ শরিফ ওসমান হাদির নামাজে জানাজায় অংশ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। জানাজায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে পুরো এলাকা পরিণত হয় মানুষের ঢেউয়ে।

হাদির বিদায় নয়, বরং তাঁর কাছে ওয়াদা করতেই এই সমবেত হওয়া বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, মানুষ আজ এখানে এসেছে এই অঙ্গীকার করতে যে, হাদি যে কথা বলে গেছেন, যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তা যেন বাস্তবায়িত হয়। এই দায়িত্ব শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাংলাদেশের মানুষ বহন করবে।

জানাজায় উপস্থিত মানুষের ঢল তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পথে পথে ঢেউয়ের মতো মানুষ আসছে। সারা বাংলাদেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষ এই মুহূর্তের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশের বাইরেও থাকা বাংলাদেশিরা হাদির কথা জানতে চায়। এই দৃশ্যই প্রমাণ করে, হাদি কোনো একটি গোষ্ঠীর নয়, তিনি হয়ে উঠেছেন মানুষের কণ্ঠস্বর।

হাদির মানবপ্রেম, মানুষের সঙ্গে তাঁর সহজ সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এসব গুণের কারণেই সবাই আজ তাঁকে স্মরণ করছে। তিনি বলেন, এই গুণগুলো যেন আমাদের মনে সবসময় জাগ্রত থাকে এবং আমরা যেন সেগুলো অনুসরণ করতে পারি।

বক্তব্যে বারবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার প্রথম পংক্তি তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, হাদি এমন এক মন্ত্র কানে দিয়ে গেছেন, যা বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন ভুলতে পারবে না। ‘বল বীর, উন্নত মম শির’ এই মন্ত্র চিরদিন জাতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। বাংলাদেশের সন্তানরা জন্মলগ্ন থেকে জীবনভর এই মন্ত্র নিজের মধ্যে ধারণ করবে, মাথা কখনো নত করবে না।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই মন্ত্র শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রমাণ করা হবে। দুনিয়ার সামনে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, কারও কাছে মাথানত করবে না। হাদি যে সাহসের ভাষা শিখিয়ে গেছেন, সেই পথেই এগোবে জাতি।

নির্বাচন ও রাজনীতির ক্ষেত্রেও হাদির রেখে যাওয়া শিক্ষার কথা তুলে ধরেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, হাদি নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন এবং সেই পথে কীভাবে মানুষের কাছে যেতে হয়, কীভাবে কষ্ট না দিয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে হয়, কীভাবে বিনীত আচরণ করতে হয়, সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এই শিক্ষা রাজনৈতিক জীবনে বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।

জানাজায় আরও বক্তব্য দেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো ওসমান হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। খুনি, পরিকল্পনাকারী ও সহায়তাকারীসহ পুরো চক্রকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচার নিশ্চিত না হলে আন্দোলন চলবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

জানাজায় প্রধান উপদেষ্টার পাশে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। জানাজার আগে ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, সংসদ ভবনের আশপাশের মাঠ ও সড়কজুড়ে ছিল মানুষের ঢল।

শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাঁকে। অবস্থার অবনতি হলে রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) তিনি মারা যান।

শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর থেকে তাঁর মরদেহ দেশে আনা হয়। পরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের মর্গে রাখা হয় মরদেহ। তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির সংগঠক ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক হিসেবে ওসমান হাদি ইনসাফভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ডাক দিয়েছিলেন। সেই ডাকই এখন তাঁর অনুপস্থিতিতে অঙ্গীকারে রূপ নিচ্ছে মানুষের কণ্ঠে।


আপনার জেলার সংবাদ পড়তে