শীতে গৃহহীনদের জীবন অত্যন্ত দুর্বিষহ। শীতকাল সাধারণ মানুষের কাছে উৎসবের হলেও, গৃহহীন ও দরিদ্র মানুষের কাছে তা বেঁচে থাকার এক কঠিন লড়াই। শীতকাল অধিকাংশ মানুষের কাছে আরামদায়ক হলেও গৃহহীন মানুষের জন্য এটি চরম কষ্টের এবং জীবনমরণ লড়াইয়ের সময়। শীতে যা এক কঠিন সংগ্রাম।
গৃহহীন ও দরিদ্র মানুষেরা খোলা আকাশের নিচে বা দুর্বল আশ্রয়ে থাকে, কম্বল ও পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পায়। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও কাজকে ব্যাহত করে এবং খাদ্য জোগাড় করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তীব্র ঠান্ডা, কুয়াশা আর বাতাসের কারণে তাদের মৌলিক চাহিদা উষ্ণতা, আশ্রয় ও খাবারের অভাব দেখা দেয়। যা বিশেষত শিশু ও বয়স্কদের জন্য জীবন-মৃত্যুর সংকট তৈরি করে।
রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, ফুটপাত এবং পার্কের খোলা জায়গায় রাত কাটাতে হয় বলে হাড়কাঁপানো শীতে তারা সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষের কষ্ট চরম আকার ধারণ করে। প্রতি বছর এই সময়ে হাজার হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে।
গৃহহীনদের শীতে খোলা আকাশের নিচে বা জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরে থাকায় ঠান্ডা বাতাস ও কুয়াশা থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না। কম্বল, কাঁথা বা গরম কাপড়ের অভাবে তীব্র শীতে তারা কাঁপতে থাকে, যা হাইপোথার্মিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ঠান্ডার কারণে কাজ কমে যাওয়ায় আয় কমে যায়, ফলে পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ে। যা তাদের আরও দুর্বল করে তোলে। ঠান্ডা, আর্দ্রতা এবং অপুষ্টির কারণে শিশু ও প্রবীণদের মধ্যে নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, ডায়রিয়া এবং অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। দিনের বেলায়ও কাজের অভাব এবং সন্ধ্যায় খালি হাতে ঘরে ফেরা, যা তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে।
শীতে গৃহহীনদের জীবন যেন এক কঠিন বাস্তবতা। শীতের প্রকোপ ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ বাড়তে থাকে। তীব্র শীত আর এক টানা ঘন কুয়াশার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তুষারাচ্ছন্ন বাতাস আর ঘন কুয়াশায়সহ হাড় কাপাঁনো শীতে জবুথবু হয়ে পড়ে। স্থায়ী মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় তারা কনকনে বাতাসের মধ্যে পাতলা প্লাস্টিক বা চটের বস্তা বিছিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র এবং কম্বলের অভাবে গৃহহীন মানুষ হাড়কাঁপানো শীতে ধুঁকতে থাকে। বিশেষ করে ফুটপাত, রেলস্টেশন বা বাস টার্মিনালে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। শিশুদের ওপর এই শীতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে। সরকারি বা বেসরকারি কিছু অস্থায়ী শেল্টার থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
শীতের কারণে কাজে বের হতে না পারায় অনেকের আয় কমে যায়, ফলে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় শীত সহ্য করা তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রচণ্ড ঠান্ডায় নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশি এবং ডায়েরিয়ার মতো রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত পুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে অনেক সময় এসব রোগ প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। প্রতি বছর শীতের প্রকোপে অনেক গৃহহীন মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা মারা যান।
শীতকালে গৃহহীন মানুষ ও পথশিশুদের কষ্টের কোনো শেষ থাকে না। নিম্নবিত্ত এবং সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য এই শীত নিয়ে আসে এক ভয়াবহ দুর্ভোগ। কনকনে শীতে ফুটপাথ, বাস, রেলস্টেশন ও বস্তিতে বসবাস করা মানুষগুলো শান্তিতে নেই। পেটে ক্ষুধা নিয়ে তাদের রাত কাটে নির্ঘুম অবস্থায় শীতের প্রকোপে জবুথবু হয়ে। আমাদের সবার উচিত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সরকারের পাশাপাশি আমরা সবাই এগিয়ে এলে শীতার্তরা উপকৃত হবে।
শীতকালে গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানো একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। শীতবস্ত্র, কম্বল, গরম কাপড় ও খাবার তাদের কষ্ট কমাতে পারে। জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র ও উষ্ণায়ন স্টেশন স্থাপন করা প্রয়োজন, যা তাদের রাতটুকু নিরাপদে কাটাতে সাহায্য করবে। যেখানে সামান্য উষ্ণতা ও সহায়তা তাদের জীবনে বড়ো পরিবর্তন আনতে পারে।
আশেপাশে থাকা অসহায় মানুষদের সহায়তায় বিত্তবানদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। পুরোনো বা নতুন শীতবস্ত্র দান করতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে অবদান রাখতে হবে। এছাড়া গরম খাবার বা কম্বল বিতরণের মাধ্যমেও তাদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব। বিত্তবান ও সাধারণ মানুষের ছোট ছোট উদ্যোগই পারে ছিন্নমূল মানুষের এই শীতে দুর্ভোগ কিছুটা লাঘব করতে।
লেখক: প্রকাশ ঘোষ বিধান; সাংবাদিক ও কলামিস্ট