ভাতারা খালের তীরে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণে এক বাড়িতেই ৭শ’ পরিবারে প্রায় ১০ হাজার লোক বসবাস করছে। এদের ভোটেই একটি ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয় এবং এরাই অখন্ড গ্রামটির হর্তাকর্তা। এটি হচ্ছে ২নং নায়ের গাঁও দক্ষিণ ইউনিয়ন ৯নং ওয়ার্ডের প্রকৃতিঘেরা মেহারণ গ্রাম।
সম্প্রতি গ্রামটি সম্পর্কে এসব তথ্য জানা যায়।
স্থানীয়রা জানান, ধনাগোদা নদী থেকে বেরিয়ে বোয়ালজুরী খালের পেটেই ভাতারা খালটির উৎপত্তি। আর এর তীর ঘেঁষেই মেহারন বিলের সাথে মিশে দু’টি প্রাচীন জমিদার বাড়ীর ওপর নির্ভর করে ঘনবসতিময় বাড়ী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে মেহারন দালাল বাড়ী। যেখানে ভোটার রয়েছে প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি।
সুবল দাস বলেন, মেহারন দালাল বাড়ির সঠিক ইতিহাস নিয়ে নানামুখী বক্তব্য থাকলেও কথিত রয়েছে আনুমানিক ৪শ’ বছর আগে মতলবের কাশিমপুর এলাকার জমিদার ও কুমিল্লার গৌরীপুর এলাকার জমিদারের মধ্যে বিবাদ থেকে রণক্ষেত্র তৈরি হয়। সেই রণক্ষেত্র শব্দটি ‘মহারণ’ নামেও পরিচিত আর এই মহারণ থেকেই মেহারন নামের উৎপত্তি।
তিনি আরও বলেন, এক সময় কুমিল্লার লাকসামের জমিদার এসে এই মতলবের আলীয়ারা গ্রামে বসে খাজনা আদায় করতেন। তবে অনেকটা দূরের হওয়ায় ওই জমিদারদের এখানকার চাষিরা খাজনা দিতে চাইতেন না। তখন লাকসামের জমিদার কালীবাবু মেহারণ গ্রামের জমিদার দ্বারিকানাথ দাস ও বৈকুণ্ঠ দাসকে খাজনা তোলার দায়িত্ব দেন। এর পর থেকে মেহারনের জমিদাররা আলীয়ারা ও নারায়ণপুর গ্রামের খাজনা উঠাতেন। এর ভাগ লাকসামের জমিদারকেও দিতেন। জমিদারদের ব্রিটিশরা উপাধি দেয় দালাল বলে। এ জন্য এ বাড়ির নাম মেহরন দালাল বাড়ি। কথিত রয়েছে জমিদার দ্বারিকানাথ দাস, বৈকুণ্ঠ দাস ও গিরিশচন্দ্র দাস যখন খাজনা আদায় করতেন, তখন স্থানীয় লোকজন তাঁদের “দালাল”বলে ডাকতেন। সে থেকে মেহারনের জমিদারদের নামের সঙ্গে “দালাল”তকমাটি যুক্ত হয়। বর্তমানে মেহারণবাসীর অনেকেই সেই জমিদারদের বংশধর।
রিপন দাস বলেন, দ্বারিকানাথ দাসরা ৪ ভাই হলেও বুদ্ধি ও মেধার দাপটে ক্ষমতাধর ব্যাক্তি হয়ে উঠে ছিলেন দ্বারিকানাথ দাস। তিনি তার চার ছেলের জন্য ২টি ভবন করেন ১২৭ বছর আগে। দুতলা ওই ২টি ভবনের প্রতি তলায় ১ জন করে মোট ৪ ভাইয়ের পরিবার সেখানে থাকতেন। এর একটি ১৩৩৫ এবং অপরটি ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে নির্মিত হয়েছিলো। যেখানে দালালদের ৪র্থ প্রজন্ম এখনও বাড়িটিতে বসবাস করছে।
দ্বারিকানাথ দাসের নাতি বৌ লাকি রানী দাস বলেন,পরিবারের পুরুষ লোকেরা মাছের কাজে জড়িত ঢাকায়। আমরা মহিলারা এখনো এখানে বসবাস করছি। লোকজন নানা সময় এসে দালাল বাড়ীর ইতিহাস জানতে চায় এবং জমিদার ভবনের ছাদে যেতে চাইলে আমরা দেখাই। আমাদের কাছে ভালোই লাগে।
মতলব উপজেলা যুব ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব চন্দন বিশ্বাস বলেন, কালের সাক্ষী হয়ে দু’টি ভবনকে ঘিরে এখন সেখানে প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে ছোট ছোট টিনের ঘর, আধা পাকা টিনের ঘর ও বেশ কিছুু দালানও গড়ে উঠেছে। এছাড়াও বাড়িটিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়, ছোট বড় মিলিয়ে ৮টি মন্দির এবং প্রায় ৬০টির মতো টিউবওয়েল আছে। দিনরাত ২৪ ঘন্টাই ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে শান্তিপূর্ণভাবেই মন্দিরগুলোতে পূজার্চনায় ব্যস্ত থাকেন মেহারনের দালাল বাড়ীর বাসিন্দারা।
মতলব উপজেলা যুব ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক সমীর ভট্টাচার্য বলেন, দালাল বাড়ীর সবাই সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বী এবং এরা অধিকাংশই জেলে। তবে চাহিদা মেটাতে এখানেই মুদি দোকান হতে শুরু করে সবজি বাজার গড়ে উঠেছে। যেখানের ক্রেতা বিক্রেতা সব এখানকার মানুষই। এ বাড়ির সড়ক অত্যান্ত সরু এবং এক ঘরের ভিতর দিয়ে অন্য ঘরে যাওয়ার চলাচলের পথ। শান্ত নিরিবিলি এ গ্রামের প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের সাথে এখানকার ছেলেদেরই অধিকাংশ সময় বিয়ে হয়। তবে পড়ালেখার সমস্যা এড়াতে জুনিয়র স্কুলটির সংস্কারের দাবী জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
মেহারন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাধব চন্দ্র দাস বলেন, এই স্কুলটিতে জরাজীর্ণ অবস্থাতেও পড়ালেখা চলছে। তবে শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাস নেয়ার ইচ্ছা থেকেও তা হচ্ছেনা। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণীর ১শ’ ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য এখানে শিক্ষক মাত্র ৫ জন। খেলার মাঠ এবং ভবনটি সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু স্কুল ভবনের জমি মন্দিরের নামে হওয়ায় স্কুলটি এমপিও ভুক্তিও করা যাচ্ছেনা। তাই প্রশাসনের সহায়তা প্রয়োজন।
২নং নায়ের গাও দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ভরত চন্দ্র দাস বলেন, মেহারন দালাল বাড়ীর নানামুখী সমস্যা রয়েছে। এরমধ্যে সেনিটাইজেশন ব্যবস্থা, টিউবওয়েল, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, উন্নত রাস্তা, মন্দির সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আকুতি মেহারনবাসীর।
২নং নায়ের গাও দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুস ছালাম মৃধা মামুন বলেন,রাস্তা মেরামতসহ যাবতীয় সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের সহায়তা চাই। আমি দায়িত্ব নিয়ে বেশ কয়েকবার রাস্তা মেরামতের উদ্যোগ নিয়েও নানা প্রতিবদ্ধকতায় করা হয়ে উঠেনি। স্কুলটির সমস্যার কথাও প্রশাসনকে অবগত করেছি।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, দ্রুতই মেহারন গ্রামটি পরিদর্শন করে তাদের স্কুলের সমস্যা সমাধানসহ যাবতীয় সব সমস্যা সমাধানে জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে উদ্যোগ নিবো।