মহান ও নিবেদিত পেশা হিসেবে শিক্ষকতা সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীগণ ডিসেম্বর ২৪ইং মাসের বেতন ভাতা জানুয়ারি মাসের শেষেও লাখ লাখ শিক্ষক কর্মচারী না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ইএফটিতে বেতন দেয়ায় কয়েক ধাপে বেতন আসলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাগণ বলছেন ব্যাংকে এখনও টাকা আসেনি। তাই হাজার হাজার শিক্ষক কর্মচারী ব্যাংকে গিয়ে টাকা না পেয়ে ফিরে নিরাশ হয়ে ফিরে আসছেন। অনেকের এখনও সমস্যার কারণে বেতন ভাতা আসে নি। এই যদি হয় শিক্ষা গুরুর অবস্থা। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই মনে করা হয় শিক্ষকদের। পাঠদানে আত্ম-নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত থাকা সুপ্ত মেধা জাগ্রত করা, দুঃস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের অর্থ ব্যয়ে দেশ সেরা হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকও দেশে বিরল নয়। এ জন্যই সমাজে শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, শিক্ষার্থীরাও যুগে যুগে স্মরণ রাখেন। পেশা হিসেবে শিক্ষকতা সর্বজন স্বীকৃত। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই মনে করা হয় শিক্ষকদের। পাঠদানে আত্ম-নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত থাকা সুপ্ত মেধা জাগ্রত করা, দুঃস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের অর্থ ব্যয়ে দেশ সেরা হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকও দেশে বিরল নয়। আজ কেন? বেসরকারি শিক্ষক সমাজ অবহেলিত, লাঞ্ছিত হচ্ছে, পুলিশ কর্মকর্তা ও শিক্ষা উপদেষ্টার পায়ে ধরে কাঁদতে হচ্ছে ? বেসরকারি শিক্ষক সমাজ কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকায় ২২ দিন লাখ লাখ শিক্ষক কর্মচারীগণ আন্দোলন করেছেন। দিন দিন যেন শিক্ষক সমাজের সম্মান তলানীতে নেমে যাচ্ছে, সরকার আসে সরকার যায় বেসরকরী শিক্ষক, কর্মচারীদের ভাগ্যের পরিবর্তন নাহি হয়। সবার বেলায় ১৬ আনা আর বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় চার আনা। অবহেলিত বেসরকারি শিক্ষক সমাজের এব্যপারে লিখার জন্য বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত নিয়ে বসলাম, লেখাটি শেষ না হতেই গত শুক্রবার মসজিদে নামাজের ব্যাপারে একটি ভিডিও দেখার সময় বাঘা মসজিদের কথা মনে পড়ে গেল, সেখানে কয়েকবার গিয়েছি, নামাজ আদায় করেছি তাই আল্লাহর নাম নিয়ে এ মসজিদ সম্পর্কে লিখা শুরু করলাম। প্রাচীন ও প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক নিদর্শন রাজশাহীর বাঘা শাহী মসজিদ। রাজশাহী শহর থেকে ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে বাঘা উপজেলা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি উঁচু টিলার উপর টেরাকোটা অলংকরণে সমৃদ্ধ দশ গম্বুজ বিশিষ্ট অতুলনীয় বাঘা মসজিদটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম মসজিদ গুলির অন্যতম। বাংলার (গৌড়) সুলতান নশরত শাহের আমলে ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদ সংলগ্ন একটি বিশাল দীঘি রয়েছে যেখানে শীতের অতিথি পাখিদের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। মসজিদ চত্বরের পার্শ্বেই রয়েছে একাধিক পীর আউলিয়াগনের মাজার। প্রতিদিন হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষসহ অসংখ্য পর্যটক মসজিদ, তৎসংলগ্ন দীঘি ও মাজার দর্শন করে থাকেন। মসজিদটি ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। সমভুমি থেকে থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙিনা তৈরি করা হয়েছে। উত্তর পাশের ফটকের ওপরের স্তম্ভ ও কারুকাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। মসজিদটিতে ১০টি গম্বুজ আছে । আর ভেতরে রয়েছে ৬টি স্তম্ভ। মসজিদটিতে ৪টি মেহরাব রয়েছে যা অত্যন্ত কারুকার্য খচিত। দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেয়াল চওড়া ৮ ফুট গম্বুজের ব্যাস ৪২ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। চৌচালা গম্বুজের ব্যাস ২০ ফুট উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। মাঝখানের দরজার ওপর ফারসি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। মসজিদটির গাঁথুনি চুন-সুরকি দিয়ে। ভেতরে এবং বাইরের দেয়ালে মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে। বাঘা মসজিদের দৈর্ঘ্য ২২.৯২ মিটার, প্রস্থ ১২.১৮ মিটার এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর দেয়াল ২.২২ মিটার পুরু। মসজিদটিতে সর্বমোট ১০টি গম্বুজ, ৪টি মিনার (যার শীর্ষদেশ গম্বুজাকৃতির) এবং ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই মসজিদটি চারদিক হতে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং প্রাচীরের দু’দিকে দু’টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদের ভিতরে-বাইরে সর্বত্রই টেরাকোটার নকশা বর্তমান। মসজিদের পাশে অবস্থিত বিশাল দিঘীও একটি দর্শনীয় স্থান। এছাড়া বাঘা মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি মাজার শরীফ ১৫২৩-২৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই ঐতিহাসিক মসজিদটি আজও আপন মহিমায় কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের ৫০ টাকার পুরোনো নোট আর ১০ টাকার স্মারক ডাকটিকিটে দেখা মেলে প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই মসজিদের। এই শাহী মসজিদটি দেখতে দর্শনার্থীদের আনাগোনা সবসময় বিদ্যমান। মসজিদটির স্থাপত্যশৈলীর আকর্ষণে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকেরা প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন বাঘা উপজেলায়। এই মসজিদটি রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে বাঘা উপজেলা সদরে অবস্থিত। মসজিদটি সমতলের আট থেকে ১০ ফুট উঁচু একটি বেদির ওপর নির্মিত। নিচে থেকে এটির দিকে তাকালে চোখ চলে যায় মসজিদের চৌচালা গম্বুজের দিকে। মসজিদে চমৎকার কারুকাজ আর টেরাকোটার নকশা পরিপূর্ণ। মসজিদের দক্ষিণ পাশ দিয়ে চলে গেছে বাঘা-ঈশ্বরদী সড়ক। সেখান থেকে উত্তর দিকে মুখ ফেরালেই মসজিদের ১০টি গম্বুজের কয়েকটি দৃশ্যমান হয়। এরপর প্রধান ফটক থেকে এর নির্মাণশৈলী দর্শনার্থীদের টেনে নিয়ে যায় মসজিদের ভেতরে। ১০ গম্বুজের এই মসজিদে রয়েছে পাঁচটি দরজা। মাঝখানের দরজার ওপর ফারসি হরফে লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। চার কোনায় রয়েছে চারটি চৌচালা গম্বুজ, ভেতরে ছয়টি স্তম্ভ, চারটি অপূর্ব কারুকার্যখচিত মেহরাব। এর নকশায় রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী আম, গোলাপ ফুলসহ নানা রকম নকশা। মসজিদের আঙিনা ঘিরে রয়েছে সীমানাপ্রাচীর। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ। দুপাশেই রয়েছে বিশাল দুটি ফটক। দক্ষিণ পাশের ফটকটি এখনো রয়েছে। সেখানেও রয়েছে দারুণ কারুকাজ। তবে উত্তর পাশের ফটকের অবস্থা আর আগের মতো নেই। এ ছাড়া মসজিদের সামনে খনন করা আছে বিশাল এক দিঘি। মসজিদের সবখানে টেরাকোটার নকশা। কিছু কিছু জায়গায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নকশা প্রতিস্থাপন করেছে। সিরাজগঞ্জের টেরাকোটা শিল্পী মদন পাল কাজটি করেছিলেন। মসজিদের উত্তর পাশে হজরত শাহদৌলা (র.) এবং তার পাঁচ সাথির মাজার অবস্থিত। এই মাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে হজরত শাহ (র.) এর পরিবারের মাজার। শাহী মসজিদ প্রাঙ্গণের বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে দুজন বাগদানী দরবেশের মাজার। এ ছাড়া এখানে আসা আরও অনেক সাধকেরও মাজারও আছে। বাঘা শাহী মসজিদসংলগ্ন মাটির নীচ থেকে আবিষ্কৃত হয় মহল পুকুর। ১৯৯৭ সালে মাজারের পশ্চিম পাশে খননকাজের সময় একটি বাঁধানো মহল পুকুরের সন্ধান মেলে। সেটি একটি সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে অন্দরমহলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিন দিক থেকে বাঁধানো সিঁড়ি ভেতরে নেমে গেছে। সরকারি বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এখানে মানত করতে আসেন প্রচুর দর্শনার্থী। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল হান্নান মসজিদের গম্বুজ ভেঙে পড়ার কিছু তথ্য কয়েক বছর আগে দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে স্থানীয় অন্যান্য ঐতিহাসিক ইমারতের সঙ্গে বাঘা শাহী মসজিদেরও ক্ষতি হয়। ভেঙে পড়ে ওপরের ১০টি গম্বুজ। তার পর থেকে দীর্ঘদিন মসজিদের ভেতরটা পরিত্যক্ত ছিল। একসময় ভেতরে টিনের ছাপরা তৈরি করে নামাজ চলত। পরে গম্বুজগুলো পুনর্নির্মিত হয়। ১৯৭৬ সালের ৩১ আগস্ট থেকে কাজ শুরু হয়, চলে ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত। এরপর ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নকশা প্রতিস্থাপন করে সিরাজগঞ্জের কারুশিল্পী মদন পালকে দিয়ে পুনরায় সংস্কার করে নেয়। বাঘা মাজারের খাদেম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু কালবেলাকে বলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তা ও এলাকার বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি কমিটি আছে। সেই কমিটি এই মসজিদ ও মাজার পরিচালনা করেন। প্রতি শুক্রবার এই মসজিদে অসংখ্য মানুষ নামাজ আদায় করতে আসেন দূরদূরান্ত থেকে।’ তিনি বলেন, ‘এই মসজিদ ঘিরে প্রায় ২৫৬ বিঘা জমির ওপর সুবিশাল দিঘি, আউলিয়াদের মাজার, মূল দরগাহ শরিফ ও জাদুঘর রয়েছে। শীতে অসংখ্য অতিথি পাখি আসে এখানে। ওই সময় দিঘির পাড়ে ভিড় করেন বহু দর্শনার্থী।’ এক সময় রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর মসজিদটি পরিদর্শন করেন। তিনি পরিদর্শন বইয়ে লেখেন, ‘৫০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ স্থাপনাটি পরিদর্শন করি। ধর্মীয় ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শন করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এর ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হলো।’ মসজিদের মোতয়াল্লি খোন্দকার মুনসুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই বছর মসজিদের বয়স ৫০০ বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষ্যে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কথা রয়েছে।’
লেখক: মোঃ হায়দার আলী, প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় গোদাগাড়ী, রাজশাহী