নরকযন্ত্রণার উড়োজাহাজ যাত্রা: যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত ফেরত পাঠানোদের করুণ কাহিনি

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
| আপডেট: ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৮:২৭ পিএম | প্রকাশ: ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৮:২৭ পিএম
নরকযন্ত্রণার উড়োজাহাজ যাত্রা: যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত ফেরত পাঠানোদের করুণ কাহিনি

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত ফেরত পাঠানো ১০৪ জন অভিবাসীর মধ্যে অন্তত দুইজনের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে ভয়াবহ নির্যাতন ও প্রতারণার এক করুণ চিত্র হিসেবে। পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুরের হরবিন্দর সিং ও কাপুরথলার লাভপ্রীত কউরের জীবনকাহিনি সেই স্বপ্নভঙ্গের করুণ সাক্ষ্য দেয়।

৪০ বছর বয়সী হরবিন্দর সিং মাত্র আট মাস আগে পাঞ্জাব থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন সমৃদ্ধ জীবনের আশায়। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের যাত্রা পরিণত হয় এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে ৪০ ঘণ্টার দীর্ঘ উড়োজাহাজ যাত্রায় তাঁকে হাতকড়া ও পায়ে শিকল পরানো অবস্থায় থাকতে হয়। শৌচাগারে যেতে চাইলেও টানাহেঁচড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়, এমনকি দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেওয়া হয় শৌচাগারের ভেতরে।

"আমাদের ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হয়নি," বলেন হরবিন্দর। "হাতকড়া পরেই খেতে বাধ্য করা হয়। অনুরোধ করেও হাতকড়া খোলা হয়নি। এই যাত্রা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও আমাদের চূর্ণবিচূর্ণ করেছে।"

হরবিন্দরের এই বিদেশযাত্রা শুরু হয় একটি প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে। একটি ট্র্যাভেল এজেন্ট ৪২ লাখ টাকার বিনিময়ে তাঁকে বৈধপথে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এই অর্থের যোগান দিতে হরবিন্দরের পরিবার তাদের একমাত্র জমি বন্ধক রাখে এবং চড়া সুদে ঋণ নেয়। কিন্তু হরবিন্দর আট মাস ধরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরতে থাকেন, শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে আটক হন এবং নির্মমভাবে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

৩০ বছর বয়সী লাভপ্রীত কউরও একইভাবে প্রতারণার শিকার হন। তিনি এবং তাঁর ১০ বছর বয়সী ছেলেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক এজেন্ট ১ কোটি টাকা নেয়। লাভপ্রীতের পরিবার এই অর্থের জন্য বিশাল ঋণ নেয়। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের 'ডাঙ্কি রুট' ব্যবহার করে কলম্বিয়া, এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, এবং মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে হয়।

"এজেন্ট বলেছিল আমাদের সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাবে, কিন্তু বাস্তবে আমাদের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঠেলে দেওয়া হয়," বলেন লাভপ্রীত। সীমান্ত অতিক্রমের পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ তাঁদের আটক করে। "আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হয়, এমনকি সিম কার্ড, কানের দুলও। পাঁচ দিন ক্যাম্পে আটকে রাখার পর আমাদের কোমর থেকে পা পর্যন্ত শিকল দিয়ে বেঁধে ফ্লাইটে তোলা হয়।"

৪০ ঘণ্টার সামরিক উড়োজাহাজ যাত্রায় তাঁদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। অমৃতসর বিমানবন্দরে নামার পর তাঁরা জানতে পারেন যে তাঁরা ভারতে ফেরত এসেছেন। "আমাদের স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়," বলেন লাভপ্রীত।

হরবিন্দর ও লাভপ্রীতের পরিবার এখন চরম অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। হরবিন্দরের স্ত্রী কুলজিন্দর কউর বলেন, "আমরা সবকিছু হারিয়েছি। আমাদের শুধু সন্তানদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ চেয়েছিলাম। এখন আমরা ঋণের ভারে ডুবে আছি এবং আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে।"

লাভপ্রীতও সরকারের কাছে প্রতারক ট্র্যাভেল এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। "সরকারের উচিত এই অপরাধীদের কাছ থেকে আমাদের টাকা ফেরত আনার ব্যবস্থা করা। আমরা শুধু আমাদের সন্তানদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ চেয়েছিলাম, এখন আমাদের কিছুই নেই।"