বরেন্দ্রভূমি বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উর্বর মাটি ও উপযুক্ত জলবায়ুর কারণে এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলাসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের জমির উর্বর মাটির ব্যাপক অপব্যবহার, বিশেষত ইটভাটায় সরবরাহ ও পুকুর ভরাটের জন্য জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়া, উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আইনে জমির উপরিভাগের মাটি কাটা নিষিদ্ধ হলেও এই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি ‘মাটি সিন্ডিকেট’ গড়ে তুলেছে। গোদাগাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় গোপনে রাতের আঁধারে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে, ফলে জমির প্রকৃত মালিকরা কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। কিন্তু এসব মাটি বিক্রি করে সিন্ডিকেট সদস্যরা লাভবান হচ্ছেন এবং তারা প্রশাসনের একাংশকে ম্যানেজ করেই এই অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজাবাড়িহাট-ছয়ঘাটি, মাছমারা, কামারপাড়া, অভয়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় রাতের আঁধারে মাটি কেটে তা ইটভাটা ও পুকুর ভরাটের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে কৃষিজমি দিন দিন অনুর্বর হয়ে পড়ছে এবং ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, যেসব ব্যক্তি একসময় দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন, তারা এখন মাটি ব্যবসার মাধ্যমে ৫ থেকে ১০টি ট্রাক্টরের মালিক হয়ে গেছেন। তারা এক হাজার থেকে চৌদ্দশ টাকার বিনিময়ে প্রতিটি ট্রাক্টর মাটি বিক্রি করছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেট প্রশাসনের একাংশকে ‘ম্যানেজ’ করে নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও স্থানীয় প্রশাসন এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্রই তুলে ধরে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হায়াত বলেন, রাতের আঁধারে অভিযান চালানো কঠিন হওয়ায় মাটি কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে এই ধরনের অপরিকল্পিত মাটি কাটা কঠোরভাবে দমন করা জরুরি। পুকুর ভরাটের বিষয়টিও উদ্বেগজনক। রাজশাহীর পবা উপজেলায় একাধিক পুকুর ভরাটের ঘটনা ঘটছে, যার ফলে জলাধার ধ্বংস হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের পানি সংকট আরও প্রকট হতে পারে। পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে কৃষিকাজে মারাত্মক প্রভাব পড়বে এবং কৃষকদের উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র অভিযান পরিচালনা করলেই সমস্যার সমাধান হবে না; প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মাটি সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা এবং কঠোর নজরদারি। অন্যথায় বরেন্দ্রভূমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে।