শিক্ষা, সাক্ষরতা এবং উন্নত দেশ

অলোক আচার্য : | প্রকাশ: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ০২:৫৩ এএম : | আপডেট: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ০২:৫৫ এএম

সাক্ষরতা শব্দটি দ্বারা প্রকৃতপক্ষে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্নতাকেই বোঝানো হয়। তবে দিন দিন এর পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে স্বাক্ষরতা শব্দটির ব্যপকতা বাড়ছে। একসময় স্বাক্ষর বলতে কেবল অক্ষর জ্ঞানের সাথে নিজের নাম লিখতে পারার দক্ষতাকেই বোঝানো হতো। তখনকার প্রেক্ষাপটে এইটুকু অর্জন করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সাক্ষরতা একটি দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশের অগ্রযাত্রায় এর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষার সাথেও সাক্ষরতার রয়েছে নিবিড় যোগসূত্র। দেখা গেছে যে দেশে সাক্ষরতার হার যত বেশি সে দেশ তত বেশি উন্নত। তবে সাক্ষরতার সাথে সাথে শিক্ষার হার বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা সাধারণত তিনটি উপায়ে অর্জিত হয়। আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক। যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় তারা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষরতা লাভ করে থাকে। তবে সরকারের বিভিন্ন উদ্যেগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিরভাগ অক্ষরজ্ঞান শুরু হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য কেবল স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি নয়। শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা এবং তা অবশ্যই গুণগত শিক্ষা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে শতভাগ শিক্ষিত জাঁতি গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে একসময়ের লক্ষ স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এখন শতভাগ শিক্ষিত জাঁতি অর্জন করা। কেবল স্বাক্ষরতা অর্জন করলেই আমাদের কাঙ্খিত অর্জন সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিসরে ’সাক্ষরতা’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ১৯০১ সালে। শুরুতে স্ব অক্ষরের সাথে অর্থ্যাৎ নিজের নাম লিখতে যে কয়টি বর্ণের প্রয়োজন সেগুলো জানলেই তাকে স্বাক্ষর বলা হতো। তখনকার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টিই ছিল চ্যালেঞ্জিং। আমাদের শুরু সেই অবস্থা থেকেই। বর্তমান অবস্থার সাথে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, আমরা আজ অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছি। পরবর্তিতে ১৯৪০ সালের দিকে পড়ালেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলে অভিহিত করা হতো। এ অবস্থা উত্তোরণের পর ষাটের দশকের দিকে পড়া ও লেখার দক্ষতার সাথে হিসাব নিকাশের যোগ্যতাসম্পন্নমানুষই সাক্ষর হিসেবে পরিগণিত হতো। আশির দশকে লেখাপড়া ও হিসাব নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতা ও দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতার দক্ষতা হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে এসব দক্ষতার পাশাপাশি যোগাযোগ দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূলত সময় এগিয়ে চলার সাথে সাথে সাক্ষরতা শব্দটির সংজ্ঞায়নে পরিবর্তন আসছে। ভবিষ্যতেও এধরনের পরিবর্তন যোগ হবে।
বাংলাদেশ বা ভারত বা পাকিস্তানে এখনও প্রচুর পূর্ণবয়স্ক নিরক্ষর লোক রয়েছে। উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, পৃথিবীর ৭৭.৫ কোটি পূর্ণ বয়স্ক নিরক্ষরের প্রায় ৭৫ শতাংশ ১০ টি রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ভারত, চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র)। পৃথিবীময় পূর্ণবয়স্ক নিরক্ষরের সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মহিলা। সর্বনিন্ম সাক্ষরতার হার তিনটি অঞ্চলে ঘনিভূত হতে দেখা যায়; দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার সাব সাহারান এলাকা। সারা বিশে^ আজও বহু মানুষ শিক্ষার আলো গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি নিজের পরিচয়ও লিখতে পারে না অনেক মানুষ। যদিও শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। তাদের সাক্ষরতা দানের উদ্দেশ্যে ইউনেস্কো ৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬৫ সালের ৮-১৯ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কোর উদ্যেগে ইরানের তেহরানে বিশ^ সাক্ষরতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়। পরে ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আর ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো দিবসটি প্রথম উদযাপন করলেও বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে আন্তার্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হচ্ছে। পৃথিবীময় ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব সামগ্রিক জনসংখ্যায় সাক্ষরতা হার হলো ৮৪.১ শতাংশ। পৃথিবীময় পুরুষ সাক্ষরতার হার ৮৮.১ শতাংশ এবং মহিলা সাক্ষরতার হার ৭৯.৭ শতাংশ। চলতি বছর মার্চে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৭৬ শতাংশ। গত দশ বছরে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬.১০ শতাংশ। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হারের ওপর ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিক্স (ইউআইএস) এর ২০১৬ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেখানে আরও বলা হয় এক দশকে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও নারীর মধ্যে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির পরিমাণ যথাক্রমে ৭৫ দশমিক ৬২ এবং৬৯ দশমিক ৯০। এই তথ্যে দেখা যায়, গত দশ বছরে শিক্ষিত যুবক ও যুব মহিলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী পুরুষ ও মহিলার মধ্যে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৯২ দশমিক ২৪ ভাগ। যা ২০০৭ সালে ছিল ৬১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ইউআইএস এর তথ্য অনুযায়ী, বিশে^র বিভিন্ন দেশের সাক্ষরতার হার অনুযায়ী ভারত ৬৯ দশমিক ৩০ ভাগ, নেপাল ৫৯ দশমিক ৬৩ ভাগ, ভুটান ৫৭ দশমিক ০৩ ভাগ ও পাকিস্তান ৫৬ দশমিক ৯৮ ভাগ সাক্ষর দিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রনালয়ের তথ্য ও বিভিন্ন আদমশুমারী অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে এই হার দাড়ায় ২৫ দশমিক ৯ শতাংশে। ১৯৯১ সালে সাক্ষরতার হার হয় ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশে। এ সময় দেশব্যাপী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ’ সমন্বিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম (ইনফেপ)’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এরপর ২০০১ সালে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাড়ায় ৪৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
শিক্ষা, শিক্ষিত মানুষের হার বা সাক্ষরতার হার এসব বিষয় স্থির কোন বিষয় নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারণ প্রতিদিনই এই কার্যক্রম চলমান। তাই একেবারে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কোন হিসাব বের করা জটিল কাজ। তবে পরিসংখ্যান যেহেতু সব কাজের তথ্য সংরক্ষণ করে সেহেতু হিসাব করা জরুরী। তাছাড়া নিজেদের এই উন্নয়নের চিত্র যতটুকু সম্ভব সঠিক হিসাব করতে হবে। কারণ এই সাক্ষরতার হার উন্নত বিশে^র মত একদিন শতভাগের কাছাকাছি বা শতভাগ অর্জন সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর এর সাথে যেহেতু দেশের অগ্রগতির বিষয়টি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত সেহেতু এটা অতি শিঘ্রই অর্জন করা হবে। তাই সঠিক চিত্র আমাদের জানা প্রয়োজন। কোন দেশের শিক্ষা বা সাক্ষরতার উন্নয়নে সেই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয়ের বিষয়টিও জড়িত। বিশে^র বিভিন্ন দেশ তাদের বাজেটের একটা বিরাট অংশ শিক্ষা খাতে নির্বাহ করে। কারণ এই একটা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারলে অন্য খাতগুলোতেও তার প্রভাব পরতে বাধ্য। শিক্ষিত জাঁতি নিয়ে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব। অর্থ্যাৎ উন্নয়নের গতি তরান্বিত করতে হলে শিক্ষিত জাঁতি গড়ে তোলার বিকল্প নেই। অন্যদিকে নিরক্ষর লোকবল নিয়ে বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। মুখ থুবড়ে পরে। ইউআইএস অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে দ্বিগুণ ব্যয় করেছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেটে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হয়। এর কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন সাধন। বর্তমান সরকার শিক্ষানুরাগী। শিক্ষা এবং শিক্ষার মূল চালিকাশক্তি শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে নানা উদ্যেগ নিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ২০০৯ সাল থেকেই বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। সেসব প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে বহু বয়স্ক নিরক্ষর পুরুষ-মহিলা আজ লিখতে পারে এবং পড়তে পারে।
মানুষকে নিজেদের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই মূলত এই দিনটির প্রচলন হয়েছে। আমরা যেহেতু এখনও পিছিয়ে রয়েছি ফলে সবাইকে শিক্ষার আওতায় আনতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সাক্ষরতা আর উন্নয়ন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। সাক্ষরতাই টেকসই সমাজ গঠনের মূল চালিকাশক্তি। টেকসই সমাজ গঠনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন তা সাক্ষরতার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। নিরক্ষতার অভিশাপ যেকোন দেশের জন্য উন্নয়নের অন্তরায়। আমাদের দেশ খুব ধীরে ধীরে সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে। এখনও আমরা আমাদের চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। আমাদের লক্ষ শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করা। দারিদ্রের দুষ্টু চক্রে পরে আজও যারা নিরক্ষতার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে তারাও অচিরেই সাক্ষরতা সম্পুন্ন হবে। আমরা চাই আধুনিক বাংলাদেশ গঠন করতে। আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। সাক্ষরতা শতভাগ করা আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ সেরকম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শতভাগ শিক্ষার হার করা। সাক্ষরতা হচ্ছে শতভাগ শিক্ষিত করার প্রাথমিক ধাপ। সেজন্য ঝরে পরার হার শূণ্যের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। নিরক্ষতা, ক্ষুধা বা দারিদ্র হলো দেশের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতাস্বরুপ। এসব সমস্যাকে মোকাবেলা করতে পারে কেবল শিক্ষা। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়নে দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে সবার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। বিশে^র মানচিত্রে একটি সুশিক্ষিত এবং উন্নত জাঁতি হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে একজন সুনাগরিক এবং স্বয়ংসম্পুন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি নাগরিকেই সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতার জরুরী। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে।

লেখক- শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW