অলস পড়ে রয়েছে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রকল্প

এফএনএস এক্সক্লুসিভ : | প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল, ২০২৫, ০৮:১৭ এএম
অলস পড়ে রয়েছে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রকল্প

আট হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নির্মিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হলেও অপারেটর নিয়োগের অভাবে তা চালু হচ্ছে না। ফলে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী থেকে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) পর্যন্ত জ্বালানি তেল পরিবহনের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম প্রকল্পটি অলস পড়ে রয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রকল্পটি উদ্বোধনের পরও অপারেশন শুরু না হওয়ায় অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। অথচ নির্মাণকাজ চলাকালেই অপারেটর নিয়োগসহ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে প্রকল্পটি চালুর সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করা সম্ভব হতো। কিন্তু এখনো অপারেটর নিয়োগ ও উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় প্রকল্পটি চালু হতে সময় লাগতে পারে আরো এক থেকে দেড় বছর। মূলত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনসহ (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের অদক্ষতা ও দূরদর্শিতার অভাবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৫ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সমুদ্র তলদেশ দিয়ে জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ইনস্টলেশন অব এসপিএম উইথ ডাবল পাইপ লাইন শীর্ষক প্রকল্পটির মূল ও সংশোধিত উন্নয়ন প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়। শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় প্রায় ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরো তিন দফা বাড়িয়ে সংশোধিত ব্যয় ৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। জিওবি ও বিপিসির অর্থায়নে প্রকল্পটিতে চায়না এক্সিম ব্যাংক ঋণ দেয়। চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করে। প্রকল্পটিতে ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। তার মধ্যে অফশোর পাইপলাইন ১৩৫ কিলোমিটার, এইচডি ক্রসিংয়ের অফশোর অংশ ১১ কিলোমিটার এবং মোট অনশোর পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার। তাছাড়া সমুদ্র থেকে মহেশখালী ট্যাংক টার্মিনাল পর্যন্ত ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি পাইপলাইন এবং মহেশখালী থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি অংশে সাগরের তলদেশে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের ৯৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং অন্যটিতে ডিজেল পরিবহনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে গভীর সমুদ্রে একটি ভাসমান মুরিং পয়েন্ট এবং মহেশখালীতে একটি স্টোরেজ ট্যাংক টার্মিনালও।

সূত্র জানায়, এসপিএম প্রকল্পের কক্সবাজার অংশে মহেশখালীতে প্রায় ৮৯ একর জমিতে তিনটি ক্রুড অয়েল ট্যাংক (প্রতিটি ৫০ হাজার ঘনমিটার), ৯০ হাজার টনের তিনটি ডিজেল ট্যাংকসহ (প্রতিটি ৩০ হাজার ঘনমিটার) স্কাডা, প্রধান পাম্প, বুস্টার পাম্প, জেনারেটর, মিটারিং স্টেশন, পেগিং স্টেশনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু অপারেটর নিয়োগ না হওয়ায় পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানি এখন এসপিএম পরিচালনা করছে। মূলত জ্বালানি তেল খালাস ও পরিবহনের সময় কমিয়ে আনার জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী অংশ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করা হয়। ওই সময় প্রাথমিকভাবে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে জ্বালানি তেল পরিবহনে সফলতা এলে বিপিসি অপারেশন কার্যক্রম শুরুর জন্য আলাদা অপারেটর নিয়োগ না দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে (সিপিপিইসি) অপারেটর নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। ওই প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের নভেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির সভায় চায়না কোম্পানির সঙ্গে অপারেটর নিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষরের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু গত জানুয়ারিতে অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সভায় ওই অনুমোদন বাতিল করে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ করে প্রকল্প পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। তবে কবে নাগাদ অপারেটর নিয়োগ করে এসপিএমের কার্যক্রম শুরু করা হবে তা নির্ধারণ করা হয়নি।

সূত্র আরো জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ই পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি কীভাবে চলবে, কারা অপারেশন করবে তার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাতে প্রকল্পের কাজ শেষের সঙ্গে সঙ্গে সুফল পাওয়া যায়। কিন্তু এসপিএমের ক্ষেত্রে এমন না হয়ে বিগত সরকারের সময়ে চীনা কোম্পানি দিয়ে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু কাজ শেষ হলেও এখন কারা অপারেশন চালাবে তার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেজন্য অপারেটর বা অপারেশন পরিচালনায় প্রতিষ্ঠান নিয়োগ না দেয়া পর্যন্ত প্রকল্পটিকে অলস অবস্থায় বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। তাতে প্রকল্পের সুফলবঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও করতে হচ্ছে। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে জ্বালানি তেল পরিবহন পুরোদমে শুরু হতে আরো বছর দেড়েক সময় লাগতে পারে। তবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কীভাবে প্রকল্পটির অপারেটর নিয়োগ করা হবে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে উন্মুক্ত দরপত্রের জন্য কাজ শুরু করা হচ্ছে, একটি কমিটিও করা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ অপারেটর নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করা যাবে সে বিষয়ে বলা যাচ্ছে না। মূলত অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ওই প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না। যদিও অপারেশনাল কাজ শুরুর জন্য বিপিসি ও মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

এদিকে এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত জানান, প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও অপারেটর নিয়োগ জটিলতায় এসপিএমের অপারেশনাল কাজ শুরু করা যায়নি। গত সরকারের সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে তা চীনা কোম্পানি পরিচালনা করবে ধরে নিয়ে অপারেটর নিয়োগে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কালে অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে জিটুজির মাধ্যমে যে অপারেটর নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল সেটা বাতিল করে ওটিএম পদ্ধতিতে অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স (ওঅ্যান্ডএম) ঠিকাদার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে