এক মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে আরেক মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ

এফএনএস (মমিনুল ইসলাম রিপন; রংপুর) : : | প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল, ২০২৫, ০৬:২৯ পিএম
এক মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে আরেক মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ

রংপুরে সিরাজুল ইসলাম নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে অন্যের অপারেশন নিজ নামে চালিয়ে প্রকৃত ‘ক্রেডিট ছিনতাই’ করার অভিযোগ তুলেছেন মনজুরুল ইসলাম নামে আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা। এ ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের মদদপুষ্ট রংপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আসিব আহসানকে দায়ী করেছেন তিনি। বিকৃত তথ্য সংবলিত লেখাকে পুঁজি করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বিভিন্ন স্থানে ফায়দা লুটছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

শনিবার (১৯ এপ্রিল) দুপুরে রংপুর নগরীর আহার হোটলের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুরুল ইসলাম। তিনি রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে দীর্ঘ ২২ বছর দায়িত্ব পালন করেন।

২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রকাশিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথাসংবলিত ‘স্মৃতিতে রণাঙ্গন’ বইয়ের ৮৯ নম্বর পৃষ্টাতে সিরাজুল ইসলামের একটি লেখা ছাপানো হয়। ওই লেখায় ‘সিরাজুল ইসলাম মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে ৬ নম্বর সেক্টরের প্রথম কোম্পানির ডেমোমোলিশন চার্জের স্পেশাল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিলাহাটি হতে মির্জাগঞ্জ রেললাইনের ২০৮ নম্বর রেলব্রিজ ধ্বংসে চালানো অপারেশনে কোম্পানি কমান্ডার শহীদ আনজারুল ইসলামের নেতৃত্বে সম্মুখসারিতে ছিলেন’থথএমন তথ্য তুলে ধরেছেন।

‘স্মৃতিতে রণাঙ্গন’ বইয়ে সিরাজুল ইসলামের লেখা এ তথ্য মিথ্যা ও প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে অন্যের অপারেশনের ক্রেডিট ছিনতাইয়ের অপচেষ্টা বলে মনে করছেন অভিযোগ আনা মনজুরুল ইসলাম। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বিগত দিনে রংপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মো. আসিব আহসান ‘স্মৃতিতে রণাঙ্গন’ নামে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন। আমি দীর্ঘদিন জেলা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পরও সে সময় জেলা প্রশাসক আমাকে বিএনপির সমর্থক তকমা লাগিয়ে প্রকাশনার কোন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেননি। শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি ডেমো বিশেষজ্ঞ ও জুনিয়র লিডার হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ার পরও আমার মূল্যায়ন হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে জুনিয়র লিডার হিসেবে দায়িত্বপালন করি এবং আমার নেতৃত্বে ৬ নম্বর সাব সেক্টর হেমকুমারী হতে প্রথম চিলাহাটি মির্জাগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যকার ২০৮ নম্বর ব্রিজটি ধ্বংস করার দায়িত্ব পড়ে । আমি এবং সহযোদ্ধা মতিউর রহমান চৌধুরী, খন্দকার গোলাম কিবরিয়া, আব্দুল লতিফ, শাহ আলম, ইসমাইল হোসেন, ইউনুস, নুরুল আমিন, রহিম উদ্দিন, সামসুলসহ ১১ জনের একটি টিম নিয়ে সন্ধ্যার পর যাত্রা শুরু করি এবং ৩০ পাউন্ড বিস্ফোরক দিয়ে রাত ৩ টার দিকে ব্রিজটি ধ্বংস করি।’

মনজুরুলের দাবি ওই অপারেশনে সিরাজুল ইসলাম ছিলেন না। তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম আমার সেকশন অধীনে থাকলেও ওই অপারেশনে তিনি ছিলেন না। অথচ জেলা প্রশাসনের ‘স্মৃতিতে রণাঙ্গন’ বইয়ে নিজে কৃতিত্ব নিয়ে ব্রিজ ধ্বংসের কাহিনী বানিয়ে যে লেখাটি তিনি ছাপিয়েছেন তা মিথ্যা। তিনি তার লেখায় নিজেকে ৬ নম্বর সেক্টরের প্রথম কোম্পানির ডেমোলিশন চার্জের একজন স্পেশাল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছেন। বাস্তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সাধারণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বিশেষ কোন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছিলেন না। যা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্টের ৩৮২১৫ ভারতীয় নম্বরে যাচাই করলে আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসন স্মৃতিতে রণাঙ্গন বইটি প্রকাশের পর সার্বিক চিত্র তুলে ধরে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগসহ আবেদন করি। সে সময় তিনি (ডিসি) ঘটনাটি দুঃখজনক বলে অভিহিত করেন এবং পরবর্তী প্রকাশনায় এটি সংশোধন করার আশ্বাস দেন। কিন্তু পরে তা আর হয়নি। আওয়ামী লীগ শাসনামলে ডিসি আসিব আহসান সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধায় পদোন্নতি নিয়ে রংপুর ত্যাগ করেন। আর সেই লেখাকে পুঁজি করে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বিভিন্ন স্থানে ফায়দা নিচ্ছেন।’

এ ধরনের ইতিহাস বিকৃত তথ্য সংবলিত লেখা প্রকাশের জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসক আসিব আহসানকে দায়ী করে মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ডিসি আসিব আহসান বিষয়টি জেনে ইচ্ছাকৃতভাবে সিরাজুল ইসলামের নামে প্রকাশ করেছেন এবং আমিসহ আমার টিমের অর্জনটি ম্লান করে দিয়েছেন। যা কোন ভাবেই কাম্য ছিল না। ডিসি প্রকাশিত বইটিতে একটি সংশোধনী দিতে পারতেন, তা তিনি দেন নি। অথচ ডিসি নিজেকে জাহির করেছেন বইটির প্রকাশক এবং সম্পাদক হিসেবে।’

সিরাজুল ইসলাম তার লেখায় মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রকাশিত বইটিতে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বলেছেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়ে বিন্নাকুড়ি আর্মি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ১৬ দিন চিকিৎসা গ্রহণ করেন। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা, তিনি আহত হলে আমরা জানতে পারতাম। তিনি নিজেকে জাহির করার জন্য অপরের সকল অপারেশন নিজের নামে চালিয়ে বাহবা নিয়েছেন। যার দায়ভার এসে পড়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের আহসানের বিরুদ্ধে। আমাদের ক্যাম্পে পাকিস্তানি আর্মি প্রথম ১৯৭১ সালের ৩০ জুন  ভোর ৫ টার দিকে আক্রমণ করে। আমরা যে অবস্থায় ছিলাম প্রস্তুতি নিয়ে তাদের মোকাবেলা করি। যুদ্ধ বেলা ১২টা পর্যন্ত চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ৭-৮ জন মারাও যায়। পক্ষান্তরে আমাদের কোন মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়নি কিংবা আহত হয়নি। বিকেলে রোল কলের সময় দুইজন মুক্তিযোদ্ধা অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে সিরাজুল একজন।’

এ সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত এধরনের লেখার জন্য ওই মুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারেপদক্ষেপ নিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার প্রতি জোর দাবি জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুরুল ইসলাম।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে