টেকনাফে হারুন ডাকাতের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জব্দ করা ৩০ লাখ টাকা ও ১৭ ভরি স্বর্ণালংকার শুল্ক বিভাগের গুদামে জমা করা হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় টেকনাফ মডেল থানায় করা মামলার এজাহারেও জব্দ টাকা ও স্বর্ণালংকারের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। এ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের আলীখালী এলাকায় হারুন ডাকাতের বাড়িতে ২ এপ্রিল দিবাগত রাত একটায় অভিযান পরিচালনা করে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। পরদিন ৩ এপ্রিল কোস্টগার্ড সদর দপ্তর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৩ এপ্রিল মধ্যরাত একটায় কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের আলীখালী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। কুখ্যাত সন্ত্রাসী মো. হারুনের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে দেশে তৈরি ১টি অস্ত্র, ৬টি তাজা গুলি, ৫টি দেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ১৭ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ ৩০ লাখ ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা, ২টি ব্যাংকের চেক বই, ১০টি সিমকার্ড এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ১৯টি পরিচয়পত্র জব্দ করা হয়। এ সময় কুখ্যাত হারুন ডাকাত যৌথ বাহিনীর অভিযান টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তাঁকে আটক করা সম্ভব হয়নি। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উদ্ধার অভিযানের ছবি ও ভিডিও পাঠানো হয়। তাতে (ছবি ও ভিডিওতে) অস্ত্র-গুলির সঙ্গে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার দেখা যায়। ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেন কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক। ৩ এপ্রিল বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই অভিযানের সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু টেকনাফ থানায় ৩ এপ্রিল দায়ের করা কোস্টগার্ডের মামলার এজাহার এবং জব্দ তালিকায় উদ্ধার ৩০ লাখ ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা এবং ১৭ ভরি স্বর্ণালংকারের তথ্য উল্লেখ নেই।
কক্সবাজার জেলা আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার্স ফোরাম কক্সবাজার শাখার সভাপতি আবদুস শুক্কুর বলেন, এক অভিযানে যা কিছু উদ্ধার বা জব্দ হবে, তা ওই মামলার এজাহারে উল্লেখ থাকতে হয়। অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য দেখাতে হয়। জব্দ মালামাল শুল্ক বিভাগে জমা দিয়ে থাকলে ওই মালের জমা রসিদ মামলার এজাহারের সঙ্গে সন্নিবেশ করতে হয়। মামলা হয়ে যাওয়ার পরে এজাহারে নতুন করে জব্দ করা কোনো কিছুর অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নেই।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের সদস্য কায়সার আহমদ বাদী হয়ে ৩ এপ্রিল থানায় অবৈধ অস্ত্র ও গুলি রাখার অপরাধে হারুন ডাকাতের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। মামলার এজাহার ও এজাহারের সঙ্গে দেওয়া জব্দ তালিকায় নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকারের উল্লেখ নেই। তবে জব্দ টাকা ও স্বর্ণালংকার শুল্ক বিভাগে জমা দেওয়ার কথা পুলিশকে মৌখিকভাবে জানিয়েছে কোস্টগার্ড। জমা হয়েছে কি না, তা তাঁর জানা নেই। অভিযানে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ অন্য কিছু উদ্ধার হয়ে থাকলে কিংবা তা শুল্ক বিভাগে জমা দিলেও তা মামলার এজাহারে উল্লেখ থাকতে হয়। কোস্টগার্ডের মামলায় তা নেই কেন, তিনি জানেননা। যৌথ অভিযানে পুলিশের কেউ ছিলেননা। মামলা রুজুর পর এজাহারে নতুন কোনো কিছু জব্দ দেখানোর সুযোগ নেই। তবে মামলা তদন্তের সময় নতুন কিছু পাওয়া গেলে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তার আদালতে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করার সুযোগ আছে। হ্নীলার আলীখালী এলাকায় হারুন ডাকাতের একটি বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। হারুনের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় হত্যা, ডাকাতি, মাদকসহ অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল হুদা বলেন, ডাকাত হারুনের বাড়িতে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে নগদ ৩০ লাখের বেশি টাকা, বিপুল স্বর্ণালংকারসহ অস্ত্র-গুলি উদ্ধারের খবর তিনি জেনেছেন। কিন্তু অভিযানের সময় তিনিসহ এলাকার কেউ ঘটনাস্থলে ছিলেননা। এলাকার কাউকে এজাহারে সাক্ষী করা হয়নি।
মামলার এজাহারে অভিযানে অংশ নেওয়া কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর আটজন সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়। এজাহারে সাক্ষী দেখানো হয় কোস্টগার্ড টেকনাফ বিসিজি স্টেশনের চারজন সদস্য রাব্বি ইসলাম, হাবিবুর রহমান, নাদিম মাহমুদ ও শরিফুল ইসলামকে।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত একটায় আলীখালীর ডাকাত হারুনের বাড়িতে তল্লাশির একপর্যায়ে শয়ন কক্ষের খাটের নিচ থেকে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে দেশে তৈরি একটি অস্ত্রসহ আলামতগুলো উদ্ধার করা হয়। পলাতক আসামি হারুন অবৈধ প্রভাব বিস্তারের জন্য অবৈধ অস্ত্র-কার্তুজ ও দেশে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র নিজ হেফাজতে ও দখলে রেখে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ধারায় অপরাধ করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি থানায় মামলা করেন।
এদিকে অভিযানের পাঁচ দিন পেরোতে চললেও সোমবার পর্যন্ত জব্দ টাকা ও স্বর্ণালংকার টেকনাফ শুল্ক গুদামে জমা করা হয়নি বলে সত্যতা নিশ্চিত করেন টেকনাফ শুল্ক বিভাগের গুদাম কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান।
মামলার এজাহারে জব্দ টাকা ও স্বর্ণালংকার কথা উল্লেখ নেই কেন জানতে চাইলে বাদী ও টেকনাফ কোস্টগার্ড স্টেশনের সদস্য কায়সার আহমদ সংবাদকর্মীদের বলেন, ‘কেন নেই সেটা আপনাকে জানাতে পারব না, সমস্যা আছে।’ শুল্ক বিভাগেও জব্দ টাকা ও স্বর্ণালংকার জমা না করার কারণ জানতে চাইলে বাদী কায়সার আহমদ বলেন, এসব গণমাধ্যমকে জানাতে তিনি বাধ্য নন।
হারুনের বাবা রসিদ মিয়া বলেন, যৌথ অভিযানে কোস্টগার্ড সদস্যরা তাঁর বাড়ি থেকে ২৫ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ ৫৮ লাখ টাকাসহ অন্যান্য মালামাল নিয়ে গেছেন। জব্দ টাকা ও স্বর্ণালংকারের বিপরীতে বৈধ কাগজপত্র তাঁদের আছে। নিজের ১০০ কানি জমিতে লবণ উৎপাদন হয়, রোহিঙ্গাদের ভাড়া দেওয়ার ২০০টি ঘর আছে। তা ছাড়া তিনি দীর্ঘ ২০ বছর সৌদি আরবে ব্যবসা করে বিপুল ধনসম্পদ করেন। মামলার এজাহারে জব্দ টাকা ও স্বর্ণালংকার উল্লেখ না থাকা রহস্যজনক।