স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। অথচ বাংলাদেশের প্রান্তিক জেলা, উপজেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে চিত্র উদ্ভাসিত হচ্ছে, তা এই অধিকারকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রাজধানীর বাইরে একটি কার্যকর, মানবিক ও আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো গড়ে তুলতে রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতা ও অবহেলা আজ ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে পুরো ব্যবস্থাটিকে। প্রায় প্রতিটি জেলা কিংবা বড় উপজেলা হাসপাতালেই চিত্র একইÑনষ্ট যন্ত্রপাতি, পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্সের অভাব, আইসিইউ চালু থাকলেও জনবল নেই, আধা-নির্মিত ভবন পড়ে আছে বছরের পর বছর। কোনো এক জায়গায় রোগী আছে, কিন্তু ওষুধ নেই। কোথাও ডাক্তার নেই, আবার কোথাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না যন্ত্রপাতি বিকল থাকার কারণে। অবকাঠামো শেষ না হওয়ায় অনেক হাসপাতাল রোগীর চাপ সামলাতে না পেরে কার্যত রেফার সেন্টারে পরিণত হয়েছেÑরোগী এলেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়, রাজশাহীতে কিংবা অন্যত্র। তাতে ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ মানুষের, চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণে বাড়ছে, এবং সবচেয়ে শোচনীয়Ñঅনেক রোগী রাস্তাতেই হারিয়ে ফেলছেন প্রাণ। চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর, নোয়াখালী, যশোর, গাজীপুরÑপ্রায় সব জায়গায় জনবল সংকট এবং যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা যেন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এসব দুরবস্থা সরকারের বিভিন্ন দফতর ও স্থানীয় প্রশাসনের জানা থাকার পরেও, বছরের পর বছর ধরে এ সংকটগুলো সমাধানের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। বরিশালের ৫০ শতাংশ চিকিৎসক পদ ফাঁকা, বাগেরহাটে ২২০ জন চিকিৎসকের স্থলে আছেন মাত্র ২১ জন, আর নড়াইলে ভবন নির্মাণের কাজই শেষ হয়নি ছয় বছরেও। এই চিত্র কেবল সংখ্যা নয়Ñএগুলো একটি ব্যর্থ নীতির প্রতিচ্ছবি, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা নয়, বরং কাগুজে প্রকল্প ও দীর্ঘসূত্রতা যেন প্রাধান্য পাচ্ছে। এই সংকট শুধু সেবার মান কমিয়ে দিচ্ছে না, বরং রাজধানী মুখী রোগীর চাপ দিন দিন বাড়িয়ে তুলছেÑফলে ঢাকাতেও হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে অসহনীয়ভাবে। একটি সুস্থ স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেবল শহরের জন্য নয়, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোর এই বেহাল অবস্থা মূলত স্বাস্থ্য খাতে সমতা ও ন্যায়ের অভাবকেই প্রকাশ করে। এখন সময় এসেছে, এ সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করে অবিলম্বে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করার। প্রতি বছর বাজেট ঘোষণায় স্বাস্থ্য খাতে বিপুল বরাদ্দের কথা বলা হলেও বাস্তবায়ন কোথায়? কেন এতগুলো মেশিন বছরের পর বছর মেরামত হচ্ছে না? কেন ভবন তৈরি হচ্ছে, অথচ চিকিৎসক নেই? কেন একজন রোগী সামান্য চিকিৎসার জন্য ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসছেন? এসব প্রশ্নের জবাব রাষ্ট্রের কাছে জনগণের ন্যায্য দাবি। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য খাতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা অবিলম্বে এসব সমস্যার সমাধানে গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। শুধু আশ্বাস নয়, দেখতে চাই দৃশ্যমান পরিবর্তন।