জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব

দক্ষিণাঞ্চলে নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি

এফএনএস (বরিশাল প্রতিবেদক) : : | প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল, ২০২৫, ০৩:৫৮ পিএম
দক্ষিণাঞ্চলে নদ-নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ছোট-বড় ১৩২টি নদ-নদীতে নাব্যতা সংকটের পাশাপাশি লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাথে ভূগর্ভস্থ পানিরস্তরও ক্রমশ নামছে। ফলে এ অঞ্চলে লবণাক্তটার মাত্রা বেড়েই চলেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নগরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসি কমপ্লেক্সে ভূগর্ভস্থ পানিরস্তর এখন প্রায় নয় ফুট নিচে নেমে গেছে। উজানে নিয়ন্ত্রণসহ বৃষ্টির অভাবে প্রবাহ হ্রাসের ফলে সাগরের নোনা পানি বরিশাল অতিক্রম করে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলা উপজেলার মেঘনার মূল প্রবাহ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। স্বাভাবিক পাঁচশ’ পিপিএম’র স্থলে সাগর পাড়ের কুয়াকাটা থেকে ১১০ কিলোমিটার উজানে বরিশাল মহানগরীর পাশদিয়ে প্রবাহমান কীর্তনখোলা নদীতে এবার সাতশ’ অতিক্রম করেছে। পিরোজপুরের বলেশ্বরে ১২শ’ এবং বরগুনার পাথরঘাটায় তা প্রায় আড়াই হাজারের ওপরে চলে যাচ্ছে। সাথে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামায় চলতি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আবাদকৃত প্রায় চার লাখ হেক্টরে বোরো ধানের কাঙ্খিত উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

সূত্রে আরও জানা গেছে, গত নভেম্বর মাস থেকে অনাবৃষ্টিতে বোরোধানে অব্যাহত সেচে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে সেচ ব্যয়ের সাথে উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে বৃষ্টির অভাবের সাথে সীমান্তের ওপারে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের ফলে নাব্যতা সংকট প্রকটাকার ধারন করায় নদ-নদীসমুহে প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হয়ে বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধিরও আশঙ্কা করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা।

যেকারণে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় কোটি মানুষের জন্য অতীতের আশির্বাদ এসব নদ-নদী যথাযথ সংরক্ষন ও উন্নয়নসহ ভাঙনরোধে সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবের সাথে প্রকৃতির বিরূপ আচরনে ক্রমশ অভিশাপ হয়ে উঠছে। প্রায় পাঁচহাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এসব নদ-নদী পরিবেশ সংকটে ক্রমশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখিন। একইসাথে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদীর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের প্রায় পাঁচশ’ কিলোমিটারে ভয়াবহ নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। একারণে নদ-নদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পরতে শুরু করেছে।

এমনকি নাব্যতা সংকটে প্রায় আড়াইলাখ টন উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতও ক্রমশ বিপদগ্রস্থ করে তুলছে। সারাদেশের আহরিত ইলিশের ৭০ ভাগই যোগান দিয়ে থাকে দক্ষিণাঞ্চল। কিন্তু ক্রমাগত নব্যতা সংকটের রেশ ধরে প্রবাহ হ্রাসসহ দুষনে নদী-নদী থেকে ইলিশ উপকূল ছাড়িয়ে গভীর সমুদ্রে চলে যাবার প্রবনতা মৎস্য বিজ্ঞানীদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

নদী বিশেষজ্ঞ এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশ্বের একমাত্র উপসাগর। যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেশ করে। আর উজানের পানি সাগরে বয়ে নিয়ে যেতে দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা, তেঁতুলিয়া, বলেশ্বর, বিষখালী, বুড়িশ্বর, আগুনমুখাসহ বিভিন্ন নদ-নদী যেমনি বর্ষা মৌসুমে দুইকুল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয়। তেমনি নদী ভাঙনও তীব্র আকার ধারন করে। কিন্তু একই নদীতে শুস্ক মৌসুমে প্রবাহ হ্রাসে নাব্যতা সংকটে নৌ-যোগাযোগসহ মৎস্য ও কৃষি ব্যবস্থাকে বিপন্ন করছে।

সূত্রে আরও জানা গেছে, দেশের তিনটি সমুদ্র বন্দর এবং সারাদেশের সাথে নৌ-যোগাযোগও দক্ষিণাঞ্চলে প্রবাহিত মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কীর্তনখোলা, বলেশ্বর, কঁচা, পায়রা ও গাবখান চ্যানেলসহ বিভিন্ন নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল। এরমধ্যে মেঘনাসহ মাঝারী ও বড় নদ-নদীগুলোতে নাব্যতা সংকটে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে চাঁদপুর হয়ে ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের এবং চট্টগ্রামের নৌ-যোগাযোগ ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পরেছে। ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার প্রসস্ত ভাটি মেঘনায় ডুবো চরে ফেরিসহ সবধরনের নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।

তবে প্রতিবছর শুস্ক মৌসুমে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সিমিত কিছু নৌপথের নাব্যতা ধরে রাখতে পলি অপসারন করা হলেও পুরো নদী ও তার প্রবাহকে সচল রাখতে কার্যকরী কোন ভূমিকা রাখা হচ্ছেনা। অথচ এসব নদ-নদী পরিবেশ, কৃষি ও মৎস্য সম্পদসহ দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নের চাবিকাঠি হলেও তার সংরক্ষন ও উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি। অথচ সারাদেশের নদ-নদীর প্রবাহ সচল রাখতে সর্বাধিক কার্যকরী ভূমিকা রাখছে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদী। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষনের অভাবেই এসব নদ-নদীর অনেকগুলোই এখন অস্তিত্ব সংকটে। অথচ নৌপথে পন্য ও যাত্রী পরিবহনে ব্যয় যেমনি সাশ্রয়ী, তেমনি নিরাপদ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০২০ সালে সেন্টার ফর এনভায়রমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) দক্ষিণাঞ্চলের ৩১টি নৌপথের এক হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার এলাকায় এক সমীক্ষায় নদীসমুহের নাব্যতা বৃদ্ধি, প্রধান নৌপথের সাথে ঘাটসমূহের সংযোগ স্থাপন, সেচ ও পানি নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলজ সম্পদ বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙনরোধের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। সমীক্ষাকৃত ৩১টি নৌপথের মধ্যে ৪৭০ কিলোমিটারে ৪২ মিলিয়ন ঘণমিটার পলি অপসারনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পাশাপাশি পরবর্তী সাত বছরে সংরক্ষন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে আরো ১৭০ মিলিয়ান ঘণমিটার পলি অপসারনের প্রস্তাব করা হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে এ লক্ষ্যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প-প্রস্তাব (ডিপিপি)অনুমোদিত হয়নি। তবে সিইজিআইএস’র প্রস্তাবনার আলোকে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিপিপিতে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথের নদ-নদী সমূহের নাব্যতা উন্নয়ন এবং সংরক্ষনসহ লঞ্চঘাট সমূহের উন্নয়নে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশী প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০ থেকে ৬৩০ পার্সেন্ট পার মিলিয়ন-পিপিএম। সেখানে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে তা ৯১০ পিপিএম-এ পৌঁছেছে। ২০১৮ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ২০১৯ সালে একই নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা আবার নয়শ’ পিপিএম এ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একই বছর ডিসেম্বরের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা বাড়তে শুরু করে। ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে শুরু করে। এপ্রিলের শুরু থেকে কীর্তনখোলায় লবনাক্ততার মাত্রা এক হাজার পিপিএম অতিক্রম করে। এমনকি সাগরের লবনাক্ত পানি বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উজানে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলা উপজেলার মেঘনা পর্যন্ত পৌছে যায়।

সূত্রে আরও জানা গেছে, গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতে ২০২১ সালের শুস্ক মৌসুমে সর্বকালের সর্বোচ্চ ২১শ’ পিপিএম লবনাক্ততা সনাক্ত হয়েছিল। যা ২০১৬ সালে ছিল ১২শ’ পিপিএম। মানবদেহের জন্য সহনীয় লবনাক্ততার মাত্রা ছয়শ’ পিপিএম হলেও শুস্কমৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক নদ-নদীতেই লবনাক্ততার মাত্রা ক্রমশ সহনীয় মাত্রার বাইরে চলে যাচ্ছে। যা সুস্থ্য পরিবেশের জন্য হুমকির সৃষ্টি করছে। এমনকি নদ-নদীর প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হবার সাথে শুস্ক মৌসুমে বরিশালে পানির স্তরও ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। খোঁদ বরিশাল নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ গভীর নলকূপেই শুস্ক মৌসুমের শুরু থেকে পানি মিলছে না। অনেক নলকূপে লবনাক্ত পানি উঠে আসছে।

কৃষি ও মৎস্য সম্পদসহ সুস্থ্য সমাজ ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির জন্য নদ-নদীর যথাযথ প্রবাহ অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকরা বলেছেন, সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় নদী বাঁচাতে অবিলম্বে যথাযথ সমীক্ষার মাধ্যমে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে