সম্প্রতি সাতক্ষীরায় বেড়েছে ব্লাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আদায়ের ঘটনা। নারীর মাধ্যমে ফাঁদ পেতে টার্গেট করা হচ্ছে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। আর ওই ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। সম্প্রতি এমনই দুটি পৃথক ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, রোববার (২০ এপ্রিল) রাত ৯টার দিকে শহরের শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্ক এলাকার শহীদ মিনারের পেছন থেকে পাওনা টাকা দিতে মাছ ব্যবসায়ীকে বাসায় ডেকে ব্লাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আদায়ের অভিযোগে দুই নারীকে আটক করে পুলিশ।
আটক দুই নারী হলেন- সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বিনেরপোতা এলাকার মুজিবুর রহমানের মেয়ে জোসনা খাতুন (২৬) এবং আশাশুনি উপজেলার গুনাকরকাটি এলাকার বিল্লাল হোসেনের মেয়ে মুন্নি (২৫)। তারা শহরের একাডেমি মসজিদ এলাকায় ভাড়া থাকেন।
ভুক্তভোগী বড়বাজারের মাছ ব্যবসায়ী ও শহরের উত্তর কাটিয়া এলাকার আবু সাঈদের ছেলে মিজানুর রহমান জানান, জোসনা খাতুন এক সময় তার বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলেন। সেই সুবাদে তাদের মধ্যে পরিচয় হয় এবং মাঝেমধ্যে জোসনা তার কাছ থেকে বাকিতে মাছ নিতেন। রোববার বিকেলে বকেয়া ১৩০০ টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে জোসনা খাতুন তাকে বাসায় ডাকেন।
তিনি বলেন, রবিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শহরের একাডেমি মসজিদের পাশে তার বাসায় গেলে তিনি আমাকে বসতে বলেন। এরপর দুই মিনিটের মধ্যে ৮-১০ জন যুবক এসে আমাকে মারধর শুরু করে। পরে হাত বেঁধে ২ লাখ টাকা দাবি করে। অনেক অনুরোধের পর তারা ৩৫ হাজার টাকায় রাজি হয়। তখন আমার শ্যালক নুরু ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে আসে। পরে একজন আমার মোবাইল নিয়ে আমার শালক নুরুর কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে আসেন। এরপর আমাকে ছেড়ে দেন।
এদিকে পরে বিষয়টি সদর থানা পুলিশকে জানালে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে দুই নারীকে আটক করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ ওই দুই নারী একটি চক্রের সদস্য। তারা সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে ব্লাকমেইল করে টাকা আদায় করেন।
সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি শামিনুল হক বলেন, এক মাছ ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করা হয়েছে। এমন অভিযোগে দুইজন নারীকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মামলা করেছে।
এদিকে এক ব্যবসায়ীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ঘরের মধ্যে বিবস্ত্র করে ৭৫ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের পর এক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে অলিখিত তিনটি নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগে পর্নোগ্রাফি আইনের ৮(১), ৮(২), ৮(৩)/৭ ও ৩৪২ ও ৩৮৫ ধারায় ৫ এপ্রিল তারিখে সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা (জিআর-১৬২/২৫, সদর) দায়ের হয়।
মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন সাতক্ষীরা সদর থানার সহকারি উপপরিদর্শক আব্দুর জব্বারসহ কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য মুকুন্দ মধুসুধনপুর গ্রামের আব্দুল কাদের, একই গ্রামের শারমিন আক্তার রিমাসহ সাতজন। মামলার বাদী ভুক্তভোগী ব্যবসায়ি কালিগঞ্জ উপজেলার গণপতিপুর গ্রামের রিপনুজ্জামান রিপন। একইভাবে সদর থানার সহকারি উপ-পরিদর্শক আব্দুর জব্বারের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার বরাবর অভিযোগও করেন রিপন।
কালিগঞ্জ উপজেলার গণপতি গ্রামের ফজর আলীর ছেলে ও নাজিমগঞ্জ বাজারের চায়না বাংলা কসমেটিকস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক রিপনুজ্জামান রিপন জানান, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের মুুকুন্দমধুসুধনপুর গ্রামের মিজানুর রহমানের মেয়ে শারমিন আক্তার রিমা তার দোকানে ছয় মাস ধরে মালপত্র কেনার সুবাদে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে গত ১৭ মার্চ বিকেলে শারমিন আক্তার রিমা তার দোকান থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকার মালামাল বাকীতে গ্রহণ করে। গত পহেলা এপ্রিল দুপুর দুটোর দিকে মোবাইলে সাতক্ষীরা শহরের নিউ মার্কেট এলাকায় এসে পাওনা টাকা নিয়ে যেতে বলে। সুলতানপুর বড়বাজার থেকে মালামাল কেনার জন্য তিনি ৫৪ হাজার ৩০০ টাকা নিয়ে ওই দিন বিকেলে নিউমার্কেটে আসেন। শারমিন আক্তার রিমার কাছ থেকে বকেয়া টাকা পাওয়ার পর তিনি মালামাল কেনার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় শারমিন আক্তার রিমা তাকে মোবাইলে তার বাসায় যেতে বলে। সে অনুযায়ী তিনি একটি ভ্যানে করে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ওই নারীর বাসা শহরের কাটিয়া সরকারপাড়ার শেখ আশরাফউদ্দিনের বাসার সামনে যান।
পরে ওই নারী টাকা দেওয়ার জন্য তাকে বাসার মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে একটি চেয়ারে বসতে দিয়ে রিমা বের হয়ে যায়। পাশের বন্ধ রুম থেকে সহকারি উপ-পরিদর্শক আব্দুর জব্বারসহ শারমিন আক্তার রিমার সাবেক স্বামী কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য মুকুন্দুপুর গ্রামের এলাহী বক্স গাজীর ছেলে আব্দুল কাদের, দেবহাটার পুষ্পকাটি গ্রামের শেখ আব্দুর রউফের ছেলে বাবলুর রহমান, পুরাতন সাতক্ষীরার সাংবাদিক পরিচয়দানকারি ফজর আলী, সদর থানার সহকারি উপ-পরিদর্শক আব্দুর জব্বারসহ আরও দুইজন বেরিয়ে আসে। এ সময় বাবলুর রহমান ও সহকারি উপ-পরিদর্শক আব্দুর জব্বার তাকে লাথি মেরে চেয়ার থেকে মেঝেতে ফেলে দেয়। এ সময় কাদের, বাবলু, ফজলু, আব্দুর জব্বারসহ কয়েকজন তাকে মারপিট করে পকেটে থাকা ৫৪ হাজার ৩০০ টাকা নিয়ে আব্দুর জব্বার তাকে হাতকড়া পরিয়ে ওই ঘরে আটকে রাখে।
আব্দুল কাদেরসহ সকলে রাত সাড়ে সাতটার দিকে তার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। উপায় না দেখে তিনি তার গ্রামের ভাই শহীদুলের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা বিকাশে আনার ব্যবস্থা করেন। তার বিকাশে থাকা এক হাজার ও শহীদুলের পাঠানো বিকাশের ২০ হাজার টাকা তারা উত্তোলন করে নেয়। কাদেরসহ ঘরের মধ্যে থাকা প্রতারক চক্রের সদস্যরা তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে একজন অজ্ঞাত নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলতে বাধ্য করে ভিডিয়ো করে। পরে ওই ভিডিয়ো বিভিন্ন লোকজনের কাছে পাঠায় তারা। এছাড়া ওই ছবি বিভিন্ন লোকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে সম্মান নষ্ট করার ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে দাবিকৃত পাঁচ লাখ টাকার জন্য ১০০ টাকার তিনটি অলিখিত নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে রাত ১০টার দিকে ছেড়ে দেয়। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। গত শনিবার তিনি সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কাছে বিস্তারিত অবহিত করার পাশাপাশি সহকারি উপ-পরিদর্শক আব্দুর জব্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অপর চারজনসহ অজ্ঞাতনামা তিন জনের বিরুদ্ধে ৫এপ্রিল থানায় মামলা করেন।
তবে সাতক্ষীরা সদর থানা সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল কাদের ও শারমিন আক্তার রিমি কখনো স্বামী স্ত্রী সেজে আবার কখনো বন্ধু সেজে দীর্ঘদিন ধরে নারীকে ব্যবহার করে ফাঁদে ফেলেছেন কমপক্ষে ৩০জন ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও সাংবাদিককে। ২০২৩ সালের ২৬ এপ্রিল তাদের পাতা ফাঁদে কালিগঞ্জের এক সাংবাদিককে পলাশপোল এলাকার একটি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে তার উপর নির্যাতনের ছবি সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে উল্টো তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। পরে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় ওই সাংবাদিকের স্ত্রী বাদি হয়ে শারমিন আক্তার রিমা ও আব্দুল কাদেরের নামে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করেন।
তবে স্থানীয় একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল বৌবাজার এলাকা, মধুমোল্লারডাঙি, সরকারপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় এ ধরণের প্রতারনা চক্র গড়ে উঠেছে। কৌশলে ফাঁদে ফেলে ব্যবসায়ি, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষজনকে জিম্মি করে বিবস্ত্র করে নারীদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ শামিনুল হক সাংবাদিকদের জানান, এ ঘটনায় রিপনুজ্জামান রিপন বাদি হয়ে পর্নোগ্রাফি আইনের ৮(১), ৮(২), ৮(৩)/৭ ও ৩৪২ ও ৩৮৫ ধারায় ৫এপ্রিল থানায় একটি মামলা (জিআর-১৬২/২৫, সদর) দায়ের করেছেন। উপ-পরিদর্শক শাহিদুল ইসলামকে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে।