নাসিরনগরের ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি মেলা

এফএনএস (আক্তার হোসেন ভূইয়া; নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : : | প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল, ২০২৫, ০৭:১৪ পিএম
নাসিরনগরের ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি মেলা

চিরাচরিত বাংলা পঞ্জিকার নিয়ম অনুযায়ী নববর্ষের দ্বিতীয় দিনে যুগ যুগ ধরে নাসিরনগরে চলে আসছে ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি মেলা।সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দুইশত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে প্রতিবছরের মতো আজ মঙ্গলবার কুলিকুন্ডা  গ্রামের কুলিকুন্ডা উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জমে উঠে দিনব্যাপী এ শুটকি মেলা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শুঁটকি ব্যবসায়ী ছাড়াও বাহারি শুঁটকির আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে ভোজন রসিকরা মেলায় আসেন শুটকি কিনতে। পছন্দের শুঁটকি ক্রয় করে তারা তৃপ্ত হন।প্রায় দুই শতাধিক নানান জাতের শুঁটকির পসরা নিয়ে বসেন দোকানিরা। এসব পসরায় ছিল  বোয়াল,গজার,শোল,বাইম, ছুড়ি, লইট্টা, পুটি ও টেংরাসহ নানান জাতের দেশীয় মাছের শুঁটকি।এমন কোন জাতের শুঁটকি নেই যা পাওয়া যায় না। তবে দেশী মাছের শুঁটকির প্রাধান্যই বেশী। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও আমদানি করা বিভিন্ন প্রজাতির শুটকি উঠে। মেলায় নাসিরনগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ব্যবসায়ীরা শুঁটকি নিয়ে আসেন। সামুদ্রিক অনেক বিরল জাতের মাছের শুঁটকি ছাড়াও ইলিশ ও কার্প জাতীয় বিভিন্ন মাছের ডিমের শুটকি উঠেছে এই মেলায়। সরজমিনে গিয়ে জানা যায়,মেলায়  লাখ লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়। শুঁটকি বিক্রির লাখ লাখ টাকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যায়। এবারের মেলায় প্রায় দুইশতাধিক নানা জাতের শুঁটকির পসরা সাজিয়ে বসে দোকানীরা। তবে এবার শুটকীর আমদানি বেশী হওয়ায়  দামও ক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল । 

স্থানীয়দের মতে ব্যতিক্রম ধর্মী শুটকি মেলার পাশাপাশি পণ্যের বিনিময়ে পণ্য যুগ যুগ ধরে চালু রয়েছে। দুইশ বছরের বেশী সময় ধরে নিয়মিত ভাবে এই মেলা বসছে। এখনো বহু পুরনো প্রথা প্রচলন থাকায় আমরা ধারণা করছি,এ মেলা আদিম কালের। এই মেলা আমাদের কুলিকুন্ডা গ্রামের ঐতিহ্যবহন করে।মেলা আয়োজনের কোন কমিটি নেই। তারপরও মেলায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করে। এই মেলা নাসিরনগরের ঐতিহ্যকে প্রদর্শন করে।

এ মেলায় আরেকটি বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে “বিনিময় প্রথা” অথ্যাৎ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য।গ্রামের লোকজন ও দোকানিদের মধ্যে চলে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বিনিময় প্রথা কিন্তু সেটি ঐতিহ্য রক্ষায় স্বল্প সময়ের জন্য।স্থানীয় কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত আলু, ডাল,সরিষা, পেয়াজ,রসুনসহ পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি ক্রয় করেন। আর এ কারণেই ধারণা করা হয় এই মেলার ইতিহাস অনেক পুরনো। মেলায় শুঁটকির পাশাপাশি গৃহস্থালি সামগ্রীসহ শিশুদের নানা ধরণের খেলনাও বিক্রি হয়। নাসিরনগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই মেলায় নানান নিরাপত্তাসহ সহযোগিতা করছে। তবে কুলিকুন্ডা গ্রাম ও নাসিরনগর উপজেলাবাসী এই মেলার জন্য প্রতিবছরেই অপেক্ষা করে ও এ গ্রামের মানুষ নানান আয়োজন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে এই মেলা উপভোগ করে। 

মেলায় শুটকি কিনতে আসা নুরপুর গ্রামের ফুলবাহার মেম্বার (৬৫) জানায়,আমরা যখন ছোট তখন বাপ-দাদার সাথে এ মেলা এসেছি। আর এখনও  শুটকি নেয়ার জন্য মেলায় আসছি। 

এদিকে উপজেলা সদরের লঙ্গণ নদীর তীরেও একই দিনে বসে “বিনিময় প্রথা” অথ্যাৎ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য। ভোরে এ মেলা বসার পর সকাল ১০টা পর্যন্ত বিনিময়ের মাধ্যমে বিক্রি চলে। আলু, ডাল,সরিষা, পেয়াজ,রসুনসহ এলাকার কৃষকরা তাদের উৎপাদিত নানা পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি ক্রয় করেন। তবে রীতি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এখানে বিক্রি হয় মৃৎশিল্পীদের হাতের তৈরি মাটির হাঁড়ি ও তৈজসপত্র। স্থানীয় কুমারদের হাতের তৈরি হাড়িঁ,পাতিল, কলস,ঝাঁঝর,থালা,ঘটি,বদনা,বাটি ,পুতুল ও প্রদীপ মেলায় মানুষের নজরকাড়ে। গ্রাম্য মেয়েদের সামান্য পয়সা সংগ্রহের জন্য নানা ডিজাইনের মাটির ব্যাংকও বিক্রি হয় এ মেলায়।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে