বিশ্বে বাল্য বিবাহে অষ্টম বাংলাদেশ; এশিয়ায় শীর্ষে

মো: হায়দার আলী
: | আপডেট: ২১ এপ্রিল, ২০২৫, ০৭:১৩ পিএম : | প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল, ২০২৫, ০৭:০৪ পিএম
বিশ্বে বাল্য বিবাহে অষ্টম বাংলাদেশ; এশিয়ায় শীর্ষে
মো: হায়দার আলী

মরণ বাঁধ ফারাক্কার কারণে পদ্মা এখন ধূধূ বালু চর নিয়ে লিখার জন্য খাতা কলম, তথ্য - উপাত্ত, নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসলাম এমন সময় জানা যায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল আহমেদ নিজে উপস্থিত হয়ে মাটিকাটা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন এবং ১৩ বছর বয়সী ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ের বাল্য বিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করেছেন। এ কর্মকর্তা গোদাগাড়ী উপজেলার বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে বেশ তৎপর রয়েছেন এর আগে তিনি দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে বন্ধ করে কনে পক্ষকেও ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়। দেশে বাল্য বিয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে মোবাইল করে এ সর্ম্পকে একটু কিছু লিখার অনুরোধ করেছেন তাই আল্লাহর নাম নিয়ে এ বিষয়ে লিখা শুরু করলাম। সমাজব্যবস্থায় বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যার মাধ্যমে নারী-পুরুষের সুখ-শান্তি, প্রেম-প্রীতির মধুরতম বন্ধন সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে মানব বংশের স্থায়িত্ব ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে। তবে বাল্যবিবাহ দেশ ও জাতির জন্য অভিশাপ। পৃথিবীর যে কয়টি দেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১২-১৮ বছরের মধ্যে। বিয়ের ১৩ মাসের মধ্যেই ৬৫% নারী সন্তান ধারণ করেন। গ্রামের নারীদের বেশিরভাগই বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান জন্ম দেন। এসব বাল্যবিবাহের অধিকাংশ কারণ হচ্ছে- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিতি, স্মার্ট ফোনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি, ছেলে মেয়ের অবাধে বিচরণ, কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা, দরিদ্রতা, সচেতনতার অভাব, প্রচলিত কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, মেয়েশিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নিরাপত্তার অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যৌতুক প্রথা এবং বাল্যবিবাহ রোধ-সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াসহ নানা কারণে বাল্য বিয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, পিতা মাতা মেয়েদের বাল্য বিয়ে দেওয়াটাকে মুখ্য, পড়া লিখা করাটাকে গৌণ বলেই মনে করছেন। বাল্যবিবাহের কারণে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণ, মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহানি, তালাক, পতিতাবৃত্তি, অপরিপক্ব সন্তান প্রসবসহ নানাবিধ জটিলতার শিকার হচ্ছে। আমার কলাম লেখার কারণে পিতামাতা সচেতন হবেন, প্রশাসন আরও কঠোর হবেন, ফলে অনেক মেয়ে বাল্য বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে, ভবিষ্যতে ডাক্তার, প্রকৌশলী, প্রভাষক, আইনবিদ, পুলিশ কর্মকর্তা, , এসিল্যান্ড, ইউএনও, ডিসি, সচিব, বিচারকসহ বিভিন্ন পেশার বড় বড় স্তরে মেয়েরা প্রতিনিধিত্ব করবেন, দেশ, সমাজ, জাতি এগিয়ে যাবে। আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদেরকে আদর্শ জাতি উপহার দিব। একটি সুস্থ জাতি পেতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মা, বলেছিলেন প্রখ্যাত মনীষী ও দার্শনিক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। অথচ এ সকল মায়েদের শিক্ষিত তো দূরের কথা বাল্য বয়সে বিয়ে হচ্ছে তাদের। বাল্য বিয়ে সমাজে এখন একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাল্যবিবাহ আইন থাকলেও তার বাস্তবে প্রয়োগ করা হচ্ছেনা এ আইনটির। এ বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের একটি যৌথ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। ‘গার্লস গোলস: হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড ফর গার্লস? অ্যাডলসেন্ট গার্লস রাইটস ওভার ৩০ ইয়ার্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে। ‘১৯৯৯ বেইজিং ঘোষণা’য় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নারীদের সার্বিক উন্নয়নে যে-সব অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি লক্ষ্যের অর্ধেকও পূরণ করতে পারেনি কোনো দেশ। এদিকে ২০৩০ জাতিসংঘের টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য আর মাত্র পাঁচ বছর বাকি থাকায় এ ক্ষেত্রে নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করার আহ্বান জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয় বিশ্বের অনেক দেশ তাদের কিশোরী মেয়েদের বিকাশের জন্য বিনিয়োগ করে শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পর্যায়েই নয় দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ব্যাপক সুফল লাভ করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। কেননা এখানে প্রতিনিয়তই নানা বৈষম্য, সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, শিক্ষার সুযোগের ঘাটতি এবং সুযোগ স্বল্পতার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে কিশোরীদের। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দিচ্ছেন ২৪ শতাংশ নারী। তা ছাড়া বিগত ১২ মাসে সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের ২৮ শতাংশ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে মাত্র ৪৭ শতাংশ নিজেদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে জেনে বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বৈশ্বিকভাবে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেড়ে ৭৯ দশমিক ১ বছর হয়েছে (গত ২৫ বছরে সাড়ে ৪ বছর বেড়েছে)। নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতি হলেও ডিজিটাল দক্ষতার দিক দিয়ে উদ্বেগজনকভাবে পিছিয়ে আছে দেশের কিশোরী ও তরুণীরা। বিশ্বে যে সাতটি দেশে নারীদের ডিজিটাল দক্ষতার হার ২ শতাংশ বা তার চেয়ে কম, সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পন্ন করতে পারে ৫৯ দশমিক ২২ শতাংশ কন্যাশিশু। তাই প্রতিবেদনে কিশোরী মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ২০৩০ এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে সরকার ও অংশীজনদের উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ‘জীবন দক্ষতা ও ডিজিটাল শিক্ষা অর্জনের সুযোগ নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি উচ্চ হারে বিদ্যমান শিশু বিয়ে এবং কন্যাশিশু ও নারীদের ওপর সহিংসতা মোকাবিলা করা; কেননা এর ফলে অল্প বয়সে ও বিপজ্জনকভাবে সন্তান ধারণের ঘটনা ঘটে এবং প্রায়ই প্রাণ হারায় ছোট্ট-বয়সী মা ও তার সন্তান।’ বাংলাদেশে ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিং বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো অনেক কন্যাশিশু স্কুলে যায় না। তারা বাল্যবিবাহের মতো ক্ষতিকর চর্চা ও সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সম্ভাবনার বিকাশের জন্য ‘অল-হ্যান্ডস-অন-ডেক’ অ্যাপ্রোচ অর্থাৎ এখন থেকে সবাই মিলে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা আবশ্যক।’ প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস বলেন, ‘শিশু বিয়ে, অল্প বয়সে ও জোরপূর্বক বিয়ের হার কমানো, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি এবং কিশোরীদের অধিকার নিশ্চিতকরণ ও জনপরিসরে মেয়েদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো অনেক কিছু করার রয়েছে।’ বিশ্বে প্রতি ৭ সেকেন্ডে ১৫ বছরের কম বয়সী একটি কন্যাশিশুর বিয়ে হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয় ১০ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের অনেক বেশি বয়সী পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, ভারত, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বিয়ের ঘটনা ঘটে। তবে ভারতে এ হার সবচেয়ে বেশি। কন্যাশিশুর বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম একটি। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়। ইউনিসেফের মতে বর্তমানে বিশ্বে ৭০ কোটি মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার। এ ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে ৯৫ কোটিতে পৌঁছতে পারে। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন, এর ফলে প্রসূতির মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যার প্রকট বাড়ছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এক দশক ধরে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে। বাল্যবিবাহ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বির্তক রয়েছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে আমাদের মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে। বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে মানুষ অনেক বেশি সচেতন। তারপরও দেশ থেকে এই ব্যাধি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্য বিবাহের হারের লজ্জা বাংলাদেশের। খবরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে প্রতি তিনটি বিয়ের দুটিতেই কনের বিয়ের বয়স থাকে ১৮ বছরের নিচে। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার সর্বোচ্চ। ৬ মার্চ ২০১৮ বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বজুড়ে বাল্যবিয়ে কমছে, কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী? ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে বাল্যবিয়ে পনেরো শতাংশ কমে এসেছে। জাতিসংঘ বলছে, সারা বিশ্বে বাল্য বিবাহের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ তার এক প্রতিবেদনে বলছে, গত এক দশকে সারা পৃথিবীতে আড়াই কোটি বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজনের বিয়ে হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই। কিন্তু এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিল প্রতি চারজনে একজন। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে বাল্যবিয়ে পনেরো শতাংশ কমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সেখানে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৫০ শতাংশ থেকে এখন ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। বাল্য বিয়ের হার বাংলাদেশেও খুব বেশি ছিল, সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার হতো। কিন্তু বর্তমানে এই হার কত সেটা নিশ্চিত করে জানা গেলেও জাতিসংঘ বলছে, বাল্যবিয়ের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু এখনও সেটা ৫০ শতাংশের উপরেই রয়ে গেছে। ঢাকায় ইউনিসেফের একজন কর্মকর্তা সোনিয়া সর্দার বলছেন, নতুন এই রিপোর্টে তারা দেখছেন বাংলাদেশেও বাল্য বিয়ের হার কমছে। তিনি বলেন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। অল্পবয়সী মেয়েরাও এখন তাদের বিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং কমিউনিটিতে যে-সব সংগঠন কাজ করে তারাও এগিয়ে এসেছে, বলেন তিনি। কিন্তু নারীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে এরকম একটি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নীনা গোস্বামী বলছেন, এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে তারা মনে করেন না। তবে তিনি মনে করেন, যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে সেটাও সম্ভব হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর দীর্ঘদিনের তৎপরতার কারণে। ‘‘এখন মোটামুটি সবাই জানে যে বিয়ের জন্যে ন্যূনতম বয়স হচ্ছে ১৮। হার কমেছে কি বেড়েছে তার চাইতেও এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই না একটি শিশুও যাতে এ ধরনের বিয়ের শিকার হয়’’, বলেন তিনি। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের এই হার এখনও খুব বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্পবয়সী মেয়েরাই এখন তাদের বিয়ে ঠেকাতে এগিয়ে আসছে। সচেতনতা বাড়ার পরেও কেন এই বিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না এই প্রশ্নের জবাবে নীনা গোস্বামী সামাজিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘‘পরিবারে মেয়ে-শিশুকে এখনও একটি দায়ভার হিসেবে মনে করা হচ্ছে।’’ তিনি বলেন, আইনে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাল্য বিবাহ প্রতিরোধের লক্ষ্যে করা আইনের বিশেষ একটি ধারার কারণে এটা ততোটা কার্যকর করা হচ্ছে না। ওই ধারাটিতে বিশেষ পরিস্থিতিতে মেয়েদের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়াকে আইনসম্মত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, ভারতে বাল্য বিবাহ কমানো সম্ভব হয়েছে নারীদের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে। তাদেরকে বাল্য বিয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বুঝিয়ে সচেতন করা হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, বাল্য বিবাহের প্রবণতা এখনও সবচেয়ে বেশি আফ্রিকায়। কিন্তু তারপরেও ইথিওপিয়াতে এধরনের বিয়ের সংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাহারা মরুভূমির আশেপাশের দেশগুলোতে প্রতি তিনজন নারীর একজনের বাল্যকালেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এক দশক আগে এটা ছিলো প্রতি পাঁচজনে একজন। জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বিশ্ব নেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্য বিবাহের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদি বলা হয়- ক্যান্সার, হৃদ্রোগ বা অন্যান্য জটিল ও প্রাণঘাতী রোগের চেয়েও বেশি ভয়ংকর বাল্যবিয়ে, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে বলে মনে হয় না। কারণ প্রাণঘাতী রোগে একজন আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি হয়। কিন্তু বাল্যবিয়ে একটা মেয়ে ও তার প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দেয়। স্বাধীন সত্তা হিসেবে একজন বালেগা মুসলিম নারী যে কোনো মুসলিম পুরুষের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। অভিভাবক তাকে জোরপূর্বক বিবাহ দিলে তা কার্যকর হবে না। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪-এর খসড়া। প্রস্তাবিতাবিত খসড়া আইনে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ এবং পুরুষের জন্য ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯২৯ সাল থেকে আইনিভাবে আগের বয়সসীমা ২১/১৮ চালু আছে। সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধের নামে এই আইন পাস করার পথে হাঁটলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এর ফলে বাল্যবিবাহ আইনগত ভিত্তি পেতে যাচ্ছে। মেয়েদের বয়স কমিয়ে আনার বিষয়টি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কেননা মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ করাটা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ। প্রচলিত আইন নিষিদ্ধ হওয়ার পরও বাল্যবিয়ে সমাজে যে রীতি চালু রয়েছে যতটা না আইনের কারণে, তার চেয়ে বেশি প্রয়োগের অভাবে। নারী-পুরুষ মিলেই তো একটি পরিবার। ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশে বিয়ের গড় বয়স ১৫.৮ বছর। আগের তুলনায় এটা কমেছে। কিন্তু এখনও ১৩-১৪ বছর বয়সেও অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। দরিদ্র বাবা-মা মনে করছে বিয়ে দিলেই মেয়ে ভালো থাকবে। আর্থ-সামাজিক নানা কারণেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হয়। আবার কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্য নিষিদ্ধ থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় ব্যাঙের ছাতার মত যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে এসব অবৈধ কারবার ফলে সেখানে ছেলে মেয়ে একসাথে পাঠদান করা হয়। অবাধে মেলা মেশার কারণে প্রেম-প্রীতি, অবৈধ গর্ভধারণ করায় বাল্য বিয়ে আশঙ্কা জনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাল্যবিয়ের প্রধান কুফল হচ্ছে অল্প বয়সেই তারা সন্তানের মা হয়। শিশুর পেটে আর এক শিশু এটা কি মেনে নেওয়া যায় ? আবার অনেক পরিবারে দেখা গেছে নববধূ বছর ঘুরতেই মা না হলে তার লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শেষ থাকে না। নিকট অতীতে বাল্যবিয়ের প্রতিবাদে প্রাণ দিয়েছে কুড়িগ্রামের রিমা। জোর করে বাল্যবিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে রিমা আক্তার নামের ৭ম শ্রেণির এক মেধাবী ছাত্রী। বিয়েতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না রিমা। এ অবস্থায় রিমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায় তার বাবা। এতে অভিমান করে রিমা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। বিয়ের উপযুক্ত বয়স কোনটি? এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কারণ একজন বালক ও বালিকার শারীরিক গঠন, স্থান, কাল ও পরিবেশভেদের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের একজন বালিকা যে বয়সে বিয়ের উপযুক্ত মনে করা হয় সেটা হয়তবা অন্য কোনো দেশে তারও আগে হতে পারে। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ কখনও ফরজ, কখনও ওয়াজিব, কখনও সুন্নাত আবার কখনো হারাম তথা নিষিদ্ধ। অতএব সোনা, রুপা ও লোহা এক পাল্লায় ওজন করা হবে হঠকারী সিদ্ধান্ত। বিয়ের উপযুক্ত বয়সের সময়টা ভালো বুঝতে পারে ব্যক্তি নিজেই। তবে অভিভাবকদের সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি। কারণ অভিভাবকরা তো এ সময়টা পার করেই বুড়ো হয়েছেন। অভিভাবকদের মনে রাখা দরকার অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে যদি অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হয়, তখন তার দায়ভার কিন্তু পিতামাতার ওপর বর্তায়। প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে কালবিলম্ব না করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। বাল্য বিয়ে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন অভিভাবকের সচেতনতা ও আইনের শাসন। যে বয়সে একটি মেয়েশিশুর খেলাধুলা করার কথা, সে বয়সে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মানসিক পরিপক্বতা না আসার কারণে তার পক্ষে অন্য সংসারে গিয়ে মানিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় নির্যাতন। আবার এও দেখা গেছে যে শারীরিক পরিপক্বতা আসার আগেই সন্তান ধারণা করার ফলে মেয়েটির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। একজন অভিভাবক হিসেবে নিজের সন্তানকে এ ধরনের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া কখনই কাম্য হতে পারে না। অথচ যুগের পর যুগ আমাদের সমাজে তা-ই হয়ে আসছে। আমরা আশা করি প্রশাসন ও স্থানীয় সচেতন মহলের মিলিত প্রয়াসে এই অভিশাপ থেকে আমাদের মেয়েরা মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। এবছর গত মার্চ মাসে অন লাইল পত্রিকার আর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বে বছরে ‘বাল্য বিবাহের’ শিকার ১২ মিলিয়ন শিশু- ইউনিসেফ বিশ্বে প্রতি বছর অন্তত ১২ মিলিয়ন শিশু ‘বাল্য বিবাহের’ শিকার হয় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল- ইউনিসেফ। এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি গত ১০ বছরে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় বাল্যবিবাহের হার প্রায় ২০ শতাংশ কমে এসেছে বলে জানানো হয়। সেই সাথে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ও উঠে আসে ইউনিসেফের প্রতিবেদনে। এ ছাড়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে তুলনামূলকভাবে অগ্রগামী হলেও এখনো নানা ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে কন্যা শিশুরা। ইউনিসেফ জানায়, বিশ্বে প্রতি চার জন কন্যা শিশুর মধ্যে এক জনকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিশ্বজুড়ে বাল্যবিবাহ রোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি শিশু বাল্য বিবাহের শিকার হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ইউনিসেফ। তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, পারিবারিক মূল্যবোধ ও জনসচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে এই হার আরও কমানো সম্ভব বলে জানায় সংস্থাটি। এদিকে, ভারত, বাংলাদেশ, চীন, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, সুদানসহ আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় সেখানে শিশু জন্মের হার অনেকাংশেই বেশি। পাশাপাশি মাথাপিছু আয়, গর্ভকালীন জটিলতায় মাতৃ-মৃত্যুর হার ও অপুষ্টিজনিত শিশুর সংখ্যাও বেশি। স্থানীয় প্রশাসনের মাঝেও আনতে হবে সচেতনতা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আরও অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। স্থানীয়ভাবে যে-সব সংগঠন কাজ করছে তাদের সবার সঙ্গে মিলে একটি জাতীয় পরিকল্পনা ঘোষণা করার এখনি সময়। সেই পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজে নেমে না পড়লে সামনে কী হবে তা বলা মুশকিল।


লেখক: মো. হায়দার আলী; প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW