জলাবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার কৃষি জমিতে ২৫ ডিএস মাত্রায় লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তাছাড়া ভুগর্ভের পানিতেও লবণের উপস্থিতি আরও ভয়াবহ। যা রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট সাতক্ষীরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের।
অন্যদিকে চলতি বোরো মৌসুমে জেলার উপকূলীয় এলাকার বহু সংখ্যক বোরো চাষি ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে উচ্চমাত্রার লবণের কারণে। এসব কৃষকরা বোরো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকা করছেন।
কালিগঞ্জ উপজেলার কামারগাতি গ্রামের বোরো চাষি মোঃ ফজর আলী জানান, চলতি ২০২৪-২৫ মৌসুমে দশ বিঘা পরিমাণ জমিতে বোরো চাষ করেছেন। কিন্তু জমিতে অতিমাত্রার লবণের কারণে বোরো ধানের কাক্সিক্ষত উৎপাদন হবে। ক্ষেতের ২০ থেকে ৩০শতাংশ ধান গাছ লবণের কারণে শুকিয়ে গেছে। ফলে চিটাধানের পরিমাণ বেশি।
একই উপজেলার কৃষক অমল কুমার জানান, চলতি মৌসুমে ৮ বিঘা পরিমাণ জমিতে বোরো চাষ করেছেন। কিন্তু জমি ও পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণ থাকায় ধানে ফলন ভালো হয়নি। তিনি বলেন, বীজতলা থেকে শুরু করে কর্তন পর্যন্ত ৮ বিঘা জমির বোরা চাষে ১লাখ ২০হাজার টাকা খরচ হবে তার। কিন্তু ক্ষেতে ধানের যে অবস্থা তাতে খরচের অর্ধেক উঠবে কিনা তা নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট সাতক্ষীরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ মোঃ সাজ্জাদুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ কৃষি জমিতে মাত্রারিক্ত লবণ দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার খাজাবাড়িয়া এলাকার বোরো চাষের জমিতে সর্বোচ্চ ২৫ ডিএস পর্যন্ত লবণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া ভূগর্ভের পানিতে লবণের উপস্থিতি আরও বেশি বলে জানান তিনি। ফলে ২০২৪-২৫ মৌসুমে বোরো ধান গবেষণা প্রকল্পের অধীনে ওই লবণ এলাকাতে পরীক্ষামূলক বিভিন্ন ধান চাষ করা হলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত ফলন হয়নি বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, অতিমাত্রার লবণের কারণে উপকূল এলাকার ধান গবেষণা প্রকল্পের অধীনে প্রদর্শণী মাঠের অধিকাংশ বোরো ধানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লবণের কারণে শুকিয়ে গেছে বোরো ক্ষেতের ধানের গাছ। তবে ওই সব লবণাক্ত এলাকাগুলোতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবিত লবণসহিঞ্চু ধানের জাত যেমন- ব্রি-ধান ৬৭, ৯৯, ৬৩ ও ১০৮ চাষ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে কৃষকদের। তিনি বলেন, এসব জাতগুলোতে যেমন লবণ সহ্য করতে পারবে, তেমনি উৎপাদনও খুব ভালো বলে জানান তিনি।
শুধু ধান গবেষণা প্রকল্পের মাঠ নয়, জেলার উপকূলীয় কালিগঞ্জ, দেবহাটা, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার অসংখ্য বোরো চাষি ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে অতিমাত্রার লবণের কারণে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা জেলার সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জমিতে লবণাক্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে এ সাতক্ষীরা অঞ্চলের কৃষিতে। তিনি বলেন, ক্রমাম্বয়ে লবণাক্তা বৃদ্ধি পেলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলে পরিবেশের যেমন মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে তেমনি, ফসল উৎপাদনেও মারাত্মক ক্ষতি হবে। তবে এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে এক্ষণে বেশি করে বৃক্ষরোপন, পুকুর ও জলাশয় তৈরী করার কোনো বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয় সাতক্ষীরার উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সামছুন নাহার জানান, জমিতে বা পানিতে লবণ একই নিয়মে থাকেনা। কখনো বেশি আবার কখনো কম থাকে। যেমন বর্ষা মৌসুমে জমিতে লবণের উপস্থিতি কমে যায়, আবার শুষ্ক মৌসুমে লবণের পরিমান বেড়ে যায়। তবে ২০২২ সালের পরিসংখ্যা অনুযায়ী ২০২৫ সাল পর্যন্ত উপকুলীয় এলাকার জমিতে লবণের উপস্থিতি দ্বিগুন হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন. কালিগঞ্জ উপজেলাতে ২০২২ সালে লবণের উপস্থিতি ৪.১ ডিএস পরিমান। সেখানে চলতি ২০২৫ সালের সর্বশেষ জরিপে লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ১০.৯ ডিএস মাত্রায়। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট জমিতে বা পানিতে লবণের যে জরিপ করেছে সেটা খুবই ভয়াবহ। ২৫ ডিএস মাত্রায় লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেলে তা যে কোনো ফসলের জন্য মারত্মক ক্ষতিকর বলে জানান।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, উপকূলীয় এলাকার কৃষি জমির পাশাপাশি ভূগর্ভের পানিতেও অতিমাত্রার লবণ পাওয়া যাচ্ছে। তবে ওই সব এলাকার কৃষকদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে বোরো চাষ করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। তাছাড়া বিলের মধ্যে সরকারি খালগুলো উন্মুক্ত করার পাশাপাশি জলাশয় এবং বেশি বেশি পুকুর দীঘি খননের সুপারিশ হয় জেলা মাসিক সমম্বয় সভার মাধ্যমে।