সাতক্ষীরায় নদীর বাঁকে বাঁকে বাক্সকল, ভাঙছে উপকূল রক্ষা বাঁধ

এফএনএস (এস.এম. শহিদুল ইসলাম; সাতক্ষীরা) : : | প্রকাশ: ৮ এপ্রিল, ২০২৫, ০৪:৪০ পিএম
সাতক্ষীরায় নদীর বাঁকে বাঁকে বাক্সকল, ভাঙছে উপকূল রক্ষা বাঁধ

বাক্সকলে ঝাঁঝরা উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় নদীর বাঁকে বাঁকে স্থাপন করা হয়েছে বাক্সকল। মাছের ঘেরে লবণ পানি তোলার লক্ষ্যে বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে অবৈধভাবে নাইন্টি পাইপ ও বাক্সকল স্থাপন করেন ঘের মালিকরা। স্থানীয়ভাবে এসব ঘের মালিকরা প্রভাবশালী। পয়সাওয়ালা তো বটেই। তাই বাক্সকল স্থাপনকারীদের টিকিটি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি কেউ। বরং এদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে অনেকে আরাম-আয়েশ করেন  বলে অভিযোগ রয়েছে। বাক্সকল অপসারণ না হওয়ায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে সাতক্ষীরার উপকূল রক্ষা বাঁধ।

সোমবার (৭ এপ্রিল) সাতক্ষীরা আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট এলাকায় গেলে খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধে অসংখ্য বাক্সকল দেখা যায়। গত ৩১ মার্চ ঈদের দিন সকালে ভাটির সময় ভেঙেছিল খোলপেটুয়ার বাঁধ। জোয়ার আসতেই সেই ভাঙনে প্লাবিত হয় বিছট, বল্লভপুরসহ ৬টি গ্রাম। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বাক্সকল উপকূল রক্ষা বাঁধকে দুর্বল করে ফেলে। এতে নদীতে পানির চাপ বাড়লে বাক্সকল দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে। এসময় ওই স্থানে ভাঙনের আশঙ্কা থাকে। আর একবার কোনভাবে ভাঙতে পারলে মুহূর্তের মধ্যে প্রলয় ঘটে যায়। যেমনটি হয়তো হয়েছে গত ঈদের দিন সকালে।

তারা আরও জানান, ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের পরানপুর ও কাঠামারির মাঝামাঝি একটি একটি বাক্সকল ভেঙে যায়। এতে নদীর পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। নূর ইসলাম নামের স্থানীয়  এক বাসিন্দার মাছের ঘেরের বাক্সকল ভেঙে ১৫ ফুট এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধের তলার মাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

এর আগে একই সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বেতনা নদীর বিনেরপোতা এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। তলিয়ে যায় সদর ও তালা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের অন্তত ৪০টি গ্রাম। যাতে মাসাধিক কাল ধরে পানিবন্দি ছিলেন এসব এলাকার মানুষ।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধে যত্রতত্র ছিদ্র করে পাইপ ও বাক্সকল বসিয়ে বেড়িবাঁধ দুর্বল করে দিয়েছে ঘের মালিক ও লবণ পানি ব্যবসায়ীরা। তারা মূলত ঘের মালিকদের কাছে নদীর লবণ পানি বিক্রির জন্য সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবৈধভাবে এসব বাক্স স্থাপন করেন।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, আশাশুনি উপজেলার উপর দিয়ে খোলপেটুয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদ প্রবাহিত। নদ-নদীর উভয় অববাহিকায় গড়ে উঠেছে মাছের ঘের। আর এসব মাছের ঘেরে লবণ পানি উত্তোলনের জন্য ঘের মালিকরা স্থাপন করেন বাক্সকল। নদীর বাঁকে বাঁকে অসংখ্য বাক্সকল স্থাপন করার কারণে উপকূল রক্ষা বাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। 

স্থানীয়রা দাবি করেন শ্যামনগরের কৈখালী ইউনিয়নজুড়ে অন্তত ২০টি স্থানে বাক্সকল রয়েছে।  এতে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ঝাঁঝরা হওয়া বেড়িবাঁধ।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৈখালী এলাকায় বাক্সকলের মাধ্যমে নদীর পানি ঘেরে বিক্রি করে সংশ্লিষ্টদের বার্ষিক আয় প্রায় ২ কোটি টাকা। এই টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন পাউবোর নিচু তলা থেকে উপরতলার কর্মকর্তারা। এজন্য বেড়িবাঁধ রক্ষায় বাক্স কল অপসারণে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও পাউবো এক প্রকার নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে কর্তৃপক্ষ।

সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৭ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোরায় প্রায় ২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বাইরে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, কোমেনের আঘাতে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলো মেরামত এখনো শেষ হয়নি।

সরকারের হিসাবে দেশে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে চলে আসার পর টানা কয়েক বছর ফসল হয় না। মিঠাপানির মাছ ও অন্যান্য প্রকৃতিবান্ধব কীটপতঙ্গের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়। এ কারণে উপকূলের বেড়িবাঁধ সুরক্ষিত রাখায় অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম-সচিব আলী নূর খান বাবুল বলেন, বাক্সকলের কারণে উপকূল রক্ষা বাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। বাক্সকল স্থাপন করা হয় উপকূল রক্ষা বাঁধ ছিদ্র করে। বাঁধের গোড়া থেকে নদী পর্যন্ত সরু খালের মতো যে অংশটি নেমে গেছে তার নাম সোড়া। নদীতে জোয়ার উঠলে এই সোড়ায় পানির চাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে বাক্সকলের ছিদ্র দিয়ে তীব্র বেগে পানি প্রবাহিত হতে থাকে। কোন কারণে একবার বাক্সকল ছিদ্র হলেই বাঁধ ভেঙে যায়। তখন আর উপায় থাকে না। তিনি উপকূল রক্ষায় বাক্সকল অপসারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন সামনে দুর্যোগ মৌসুম। প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসে উপকূলে কোন না কোন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বিগত বছরগুলোতে এমনটাই দেখা গেছে। এবছরও দুর্যোগ আসতে পারে। তাই নতুন আর একটি দুর্যোগ আসার আগে উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বাক্সকল অপসারণ জরুরী। 

সাতক্ষীরা জলবায়ু অধি পরামর্শ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র আঘাতের ১৬ বছরেও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। 

তিনি বলেন, ২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় (সুপার সাইক্লোন) ‘সিডর’-এর দুই বছরের মধ্যে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয় ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে এবং ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে। টানা ১৫ ঘণ্টার ঝড় ও ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ এলাকায় দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম লবণ পানিতে তলিয়ে যায়।

বহু কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের ভেসে গিয়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নিহত হন শিশুসহ ৭৩ জন নারী-পুরুষ। হাজার হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। উপকূলজুড়ে অর্থনীতিতে পড়ে বিরূপ প্রভাব। আইলার সেই ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, ওই বছরের ১০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান, ২০২১ সালে ২৬ মে ইয়াস, ২০২২ সালের ১২ মে অশনি এবং ২০২৩ সালের ১৪ মে ‘মোখা’ আঘাত হানে। এতে আরও ক্ষয়ক্ষতি হয়। সর্বশেষ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল।

মাধব দত্ত বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে যত ক্ষতি হয় তার শতগুণ ক্ষতি হয় জলোচ্ছ্বাসজনিত কারণে উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে। আর বাঁধ ভাঙার অন্যতম কারণ বাক্সকল। উপকূলীয় বোর্ড গঠণের মাধ্যমে তিনি উপকূল রক্ষার দাবি জানান।

 পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধতন কর্মকর্তা ড. সাইফুদ্দিন আহমেদকে বিষয়টি সম্পর্কে জানালে তিনি বলেন, আমরা দ্রুত ভাঙনকবলিত এলাকা সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছি। সাতক্ষীরায় দশটি পয়েন্টে প্রায় চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। অবিলম্বে এসব ঝুকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো মেরামত করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক থেকে ফান্ড পাশ হলে টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে।

 তবে, অবৈধ বাক্সকলগুলো অপসারণের বিষয়ে পাউবোর দায় এড়িয়ে যান তিনি। বলেন, বাক্সকল অপসারণ উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের উপর নির্ভর করে।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে