সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার ৩দিন পর সোমবার সকালে এ মামলাটি করেন নিহত হানিফের ছোট ভাই হরিণাকুন্ডু উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহ-সভাপতি সাজেদুল ইসলাম এশা।শৈলকুপায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির কমান্ডার হানিফসহ ৩ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুই জনকে আটক করেছে র্যাব-৬। সোমবার রাতে ঝিনাইদহ শহর ও গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। আটককৃতরা হলো-হরিণাকুন্ডু উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের ছানোয়ার হোসেন ছনুর ছেলে আবু সাঈদ ও জোড়া পুকুরিয়া গ্রামের মৃত আনজের আলীর ছেলে আনারুল ইসলাম।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শৈলকূপা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান। তিনি জানান, শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টার দিকে উপজেলার রামচন্দ্রপুর ত্রিবেণি শ্মশান খাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার এজহারে কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। মামলায় অজ্ঞাতনামা ১৫/২০ জনকে আসামি করা হয়েছে।ওসি আরও জানান, ঘটনার পরদিন শনিবার বিকেলে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল মর্গে ৩ জনের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। এরপর সন্ধ্যার দিকে মরদেহ তিনটি তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচ জনকে ব্রাশফায়ার ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল।নিহত হানিফ বিগত সরকারের আমলে মৎস্যজীবীলীগের উপজেলা কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন ও তার লোকজন নিয়ে কয়েতপাড়া বাওড়ের নিয়ন্ত্রণ নেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর হানিফ অন্য একটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একটি শাখা ‘জনযুদ্ধ’। এই শাখার সামরিক কমান্ডার ছিলেন হানিফ। ১৯৯০ দশকে হরিণাকুন্ডু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তিনি। গত ৭/৮ বছর ধরে হরিনাকুন্ডুর নারানকান্দি বাওড় দখল করে মাছ চাষ করছিলেন হানিফ। ২০১৪ সালে তিনি জেল থেকে বের হন। ২০১৭ সালে ওই বাওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউল হককে গুলি করে হত্যা করে বাওড়ের দখল নেন তিনি। নিহত হানিফের এক ভাই হরিণাকুন্ডু উপজেলার নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। অপর ভাই উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি বলেও জানান এলাকাবাসী।১৯৯০ সালে ঝিনাইদহ এলাকায় চরমপন্থিদের গোপন সংগঠনের ব্যাপক প্রভাব ছিল। তারা সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ গণবাহিনী নামে সক্রিয় ছিল। পরবর্তী সময়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে অনেকেই খুন হন, কেউ গ্রেফতার হন, আবার কেউবা দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে চলে যান। নিহত হানিফ ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল জিয়াউর রাহমান জিয়া নামে আরেকজনকে হত্যা করে বাওড়ের নিয়ন্ত্রণ নেন। ১০৮ হেক্টরের ওই বাওড় এলাকার ‘মৎস্য ভান্ডার’ নামে পরিচিত। বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয় ওই বাওড় থেকে।ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া বলেন, ‘হানিফ নিষিদ্ধ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, অপহরণ, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ ১৫টি মামলা ছিল। চরমপন্থি নেতা হানিফের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে কুলবাড়িয়া গ্রামের আবদুর রহমান, তিওরবিলা গ্রামের লুৎফর রহমান, তাহেরহুদার গ্রামের আবদুল কাদের ও পোলতাডাঙ্গার ইজাল মাস্টারসহ প্রায় ১০ জনকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে। ইজাল মাস্টারকে হত্যার পর তার মাথা কেটে ফুটবল খেলেছিল হানিফ। সে সময় বিষয়টি দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর শৈলকুপার শেখপাড়া গ্রামের শহীদ খাঁ, ত্রিবেনী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করে চরমপন্থিরা। এই মামলায় ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর কুষ্টিয়ার আলী রেজা ওরফে কালু ও কুষ্টিয়ার ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের মহসিন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হউপজেলার আহাদনগর গ্রামের কৃষক রাহাজ উদ্দিনের ৬ ছেলে, ২ মেয়ে। তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলে হানিফ আলী ছোটবেলা থেকে ছিলেন নম্র-ভদ্র লেখাপড়ায় তেমন পারদর্শী না হলেও ফুটবলে ছিল তাঁর ব্যাপক নামডাক। নিজ গ্রাম এবং আশপাশের বিভিন্ন মাঠে খেলা হলেই ডাক পড়ত। ভালো ফুটবলার হিসেবে চারদিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এসব নব্বইয়ের দশকের কথা।তখন হানিফের ওপর নজর পড়ে স্থানীয় দুই চরমপন্থী নেতা টিপু ও মোয়াজ্জেমের। তাঁরা নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁকে নিজেদের দলে টানেন। তিনি হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক নেতা।
আব্দুল গনির সঙ্গে কথা চলাকালে এগিয়ে আসেন হানিফের বড় ভাবি সুজাতারা। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলে তিনি বলেন, একদিন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পার্শ্ববর্তী রিষখালি গ্রামের টিপু ও ভায়না গ্রামের মোয়াজ্জেম আমাদের বাড়িতে আসে। হানিফকে ফুসলাতে থাকে তাদের দলে যোগ দিতে। রাজি না হলে একদিন ওরা হানিফের বাড়ির বাইরে একটি মাচার নিচে কাফনের তিন টুকরা কাপড় ও সাবান রেখে যায়। এরপর কথা না শুনলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। কিছুদিন পর টিপু ও মোয়াজ্জেম বাড়িতে এসে হানিফের হাতে একটি অস্ত্র দিয়ে বলে, আজ থেকে তুমি আমাদের দলে কাজ করবে। এ বলে চলে যায়। সেদিনই হানিফ অস্ত্রটি স্থানীয় থানায় জমা দিয়ে দেয়। এ ঘটনার পরে হানিফকে আরও ভয় দেখায় তারা। একদিন রাতে হঠাৎ তারা এক ধামা মুড়ি-বাতাসা আর একটি কোরআন শরিফ নিয়ে হাজির হয়। হানিফকে কোরআন শপথ করিয়ে তাদের দলে যুক্ত করে। আর মুড়ি-বাতাসা খেয়ে আনন্দ করে চলে যায়। এরপর থেকে বাঁচার জন্য হানিফ ওদের সঙ্গে কাজ শুরু করে। আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে চরমপন্থী দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক নেতা।সুজাতারা জানান, অনেক বছর আগে টিপুকে সন্ত্রাসীরা মেরে মাঠে পুঁতে রেখেছিল। আর মোয়াজ্জেম আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যান।এর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) সামরিক কমান্ডর হানিফ (৫৬), তার শ্যালক লিটন হোসেন (৩৬) ও রাইসুল ইসলাম (২৮) সহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার সীমান্তবর্তী উপজেলার রামচন্দ্রপুর ত্রিবেণি শ্মশান খাল এলাকায় এ হত্যার ঘটনা ঘটে।