গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত আমদানি করা চিনির সিরা, ক্ষতিকর রং ও বিষাক্ত কেমিক্যালে প্রতিদিন উৎপাদন করছে বিপুল পরিমাণ খেজুর ও আখের গুড়। যা খেয়ে নিজের অজান্তেই পেটের পীড়া থেকে শুরু করে জটিল-কঠিন কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জনপদের সাধারণ মানুষ। সারা বছর বাঙালির নিয়মিত খাদ্য তালিকায় জায়গা করে নেওয়া গুড়ের যোগান আসে খুলনার পাইকগাছায় নাছিরপুর পাল পাড়ার ঘরে ঘরে গড়ে ওঠা কৃত্রিম গুড়ের কারখানা থেকে নিজেদের অজান্তেই সাধারণ মানুষ টাকা দিয়ে রোগ কিনে ঘরে ফিরছে। আর চুপিসারে নিরব ঘাতক হিসেবে এসব গুড় পৌছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। বুধবার সকালে ভেজাল নিম্নমানের গুড় তৈরীর সত্যতা থাকায় দুই ব্যবসায়ীকে ভোক্তা অধিকার আইন, ২০০৯ এর অধীনে ভ্রাম্যমা আদালতে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ও নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট ইফতেখারুল ইসলাম শামীম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো: হাসিবুর রহমান। ভ্রাম্যমাণ আদালতে সহকারী কমিশনার ভূমি বলেন, জনস্বার্থে আমাদের এ অভিযান চলমান থাকবে। সুন্দরবন উপকূলীয় ঐতিহ্যবাহী ব্যাস্ততম পাইকারি মোকাম কপিলমুনি। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর খুচরা ও পাইকারী যোগান আসে এ কপিলমুনি(বিনোদগঞ্জ) থেকে। আর এ মোকামকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পালপাড়ার একটি চক্র দীর্ঘ দিন যাবৎ সকলের সামনে চালিয়ে যাচ্ছে এ নিষিদ্ধ কারবার। এ ব্যবসার সাথে জড়িতরা অল্প দিনে স্বল্প পুঁজিতে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে।স্থানীয়রা জানান, আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে এর সাথে জড়িত চক্রটি ব্যাপকহারে কৃত্রিম গুড়ের উৎপাদনের পাশাপাশি বাজারজাত ও মজুদ করছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কারখানা মালিক দিন-রাত ভেজাল গুড় প্রস্তুত করছে। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই গড়ে উঠেছে এসব কারখানা। যার অন্যতম স্পট কপিলমুনির নাছিরপুর পাল পাড়া। ইতোমধ্যে গুড় উৎপাদন পট্টি বলেও জনশ্রুতি তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি পালা পাড়ারই এক বাসিন্দা কিনু পালের পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর দাখিলকৃত একটি অভিযোগপত্রের সূত্র ধরে অভিযানে সত্যতা মেলে। অভিযোগে তিনি বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কপিলমুনি (বিনোদগঞ্জ) বাজার। প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ কৃষি পণ্য থেকে শুরু করে নানা পণ্য সামগ্রী বিকিকিনিতে ছুটে আসেন এখানে। আর এই সুযোগে কপিলমুনির গৌতম পাল ও তার সহোদর কিনুপাল দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিজস্ব কারখানায় বিষাক্ত গুড় উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন। সরেজমিনে প্রথমেই দেখা যায়, কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে। স্যাতসেঁতে নোংরা পরিবেশে বিষাক্ত কেমিক্যাল বিভিন্ন পাত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে আলামত লুকাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন কারখানায় নিয়োজিত উৎপাদন কর্মীরা। নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয়রা জানান, খাঁটি গুড়ের দুষ্প্রাপ্যতা ও সহজলোভ্য না হওয়ায় অপেক্ষাকৃত অনেক কম দামে ভেজাল গুড়ের চাহিদা বাজারে বেশি। গুড়ের চেয়ে বর্তমানে চিনির বাজার দাম কম। এর সাথে ইন্ডিয়ান এলসির গো-খাদ্য হিসেবে আমদানি করা চিনির পচা সিরার সাথে ক্ষতিকর রং ও বিশাক্ত রাসায়নিকের সংমিশ্রনে চুলায় জ্বালিয়ে তৈরি হচ্ছে খাঁটি খেজুর ও আখের গুড়। চিনির চেয়ে বর্তমান খেজুর গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় প্রতি কেজি চিনি মিশিয়ে তারা ৫০ টাকা লাভ করছেন। আর তা যদি হয় ইন্ডিয়ান পচা উচ্ছিষ্ট চিনি বা সিরা! তাহলে লাভের পরিমাণ আরো বেশি। কারখানাগুলোর প্রতিটিতে অস্বাস্থ্যকর ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর সংমিশ্রণে উৎপাদন হচ্ছে শত শত মণ ভেজাল বা নকল গুড়। আর উৎপাদিত এসব ভেজাল গুড়ে বাড়িতে চমক লাগাতে ব্যবহার হচ্ছে বিষাক্ত রং ও হাইড্রোজ (সোডিয়াম হাইড্রো-সালফাইট)। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গুড় ব্যবসায়ী জানান, চিনির সিরায় তৈরি গুড় খাঁটি গুড়ের চেয়ে বেশি শক্ত ও দানাদার হয়। আর তা সহজে ভাঙেও না। অন্যদিকে, খাঁটি গুড়ের দানা হয় মোলায়েম ও চিকন। মুখে দিলে সহজে গলে যায়। রং দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ভেজাল গুড়ে লাল ও কমলা রং মিশানো হয়। যদিও অল্প দিনেই সেই গুড়ের রং পরিবর্তন হয়ে যায়। এ ছাড়া গুড় উজ্জ্বল ফর্সা দেখাতে চুন, ফিটকিরি ও হাইড্রোজ ব্যবহার করা হয়। স্থানীয়রা বলেন, এসব গুড়ের কারখানা মালিকরা বছরের পর বছর ধরে এমনিভাবে ভেজাল গুড় প্রস্তুত ও বাজারজাত করলেও এরসাথে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এক অজ্ঞাত কারণে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেননা। এসব চিনির সিরা বিক্রেতা জানান, মূলত গো-খাদ্য হিসেবে ইন্ডিয়ান চিনির সিরা আমদানি ও বিক্রি করেন তারা। তবে তাদের কাছ থেকে কারা ও কি কারণে এসব সিরা কিনছেন সেটা তাদের জানার বিষয় না হলেও এর মূল ক্রেতা ভেজাল গুড় কারখানার মালিকরা ও গাছ কাটার গাছিরাও রয়েছেন বলে জান তিনি। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ জাহেরের মতে, এসব গুড় খেলে কিডনি ও লিভার অকেজো হওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ শিশুদের চিন্তাশক্তি হ্রাস পায়। দীর্ঘদিন এসব গুড় খেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।