ছাত্র আন্দোলনে এক হাত হারা রানা: খবর রাখে না কেউ

এফএনএস (ওবায়দুল ইসলাম; সৈয়দপুর, নীলফামারী) : : | প্রকাশ: ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০২:১৪ এএম : | আপডেট: ৫ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:৩৫ পিএম
ছাত্র আন্দোলনে এক হাত হারা রানা: খবর রাখে না কেউ

স্বপ্ন ছিল দুই বোন আর বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দর একটা পরিবার গড়ার। অভানের সংসারে বাবাকে সহযোগিতা করার। আর ওই স্বপ্নে বিভোর ছিল রানা ইসলাম। 

তাই বিভোর স্বপ্ন বাস্তবায়নের বুক ভরা আশা নিয়ে একটা কর্মের সন্ধানে নীলফামারীর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে চলে আসেন আজব শহর ঢাকায়। এখানে আসার পর শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তিনি ২৫ জুলাই বসুন্ধরা এলাকায় যোগ দেন ছাত্র আন্দোলনে। ওই আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আজ নিজ গ্রাম নীলফামারীর ময়দান পাড়ায় মৃত্যুর সাথে সংগ্রাম করছেন। এখন আর কেউ নেয় না তার খবর।

নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের  তিলবাড়ী ময়দান পাড়া এলাকার মিজানুর রহমানের ছেলে রানা ইসলাম (২০)। ওই আন্দোলনে অংশ নিয়ে হারাতে হয় তার একটি হাত। অপর হাতটিও অচল প্রায়। পেটে,পায়ে আগুনের পোড়ার ক্ষত চিহ্ন।  ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে তিনমাস চিকিৎসাধীন থাকার পর অর্থের অভাবে সেখানে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পেরে গত ১৮ অক্টোবর  রানাকে বাড়ীতে নিয়ে আসে তার বাবা মিজানুর রহমান।

ছাত্র আন্দোলনে আহত রানা ইসলাম বলেন,আমি গত ২৫ জুলাই দুপুরে ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় সরকার পতনের ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেই। এসময় আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিলাম। হঠাৎ পুলিশের গুলি চলতে থাকে আমাদের উপর। পুলিশের গুলি থেকে বাঁচতে সবার সঙ্গে আমিও পালানোর চেষ্টায় দৌড় দেই।  একটি বিকট শব্দের পর আমি আর কিছু বলতে পারি না। যখন আমার জ্ঞান ফিরে, তখন আমি উঠে দেখি হাসপাতালে। আমার একটি হাত নেই। অপর হাতেও কোনো শক্তি নেই। কে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসলো সেটিও বলতে পারি না। রানা আরও বলেন,'আমি গরিব পরিবারের সন্তান। আমার বাবা একজন দিনমজুর। বাবা অনেক কষ্ট করে সংসার চালায়। তাই বাবাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য আমি ঢাকায় যাই কর্মের খোঁজে। সেখানে গিয়ে আন্দোলনের কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্যদের সঙ্গে আমিও ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে এখন পঙ্গুত্ব বরণ করেছি।  আমার চিকিৎসার পিছনে বাবার যতটুকু সঞ্চয় ছিল সব কিছু ব্যয় করেছে আমার পিছনে। এখনও আমি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারিনি। ঠিকমত হাঁটতে পারি না, চলতে পারি না, খাইতে পারি না। আমি এখন পরিবারের বড় বোঝা হয়ে গেছি।

পরিবারের সদস্যরাও রানার আহত হওয়ার খবর পায় ঘটনার একদিন পর। যার সঙ্গে কাজের খোজে ঢাকায় গিয়েছিল সে খবর দেয় তার বাবাকে। 

রানার বাবা মিজানুর রহমানের সাথে কথা হলে  বলেন,'গত ২৫ জুলাই ঢাকায় আন্দোলন চলছে ওইদিন আমি রানাকে বার বার ফোনে কল দেই কিন্তু ফোন বন্ধ। পরের দিন যার সঙ্গে কাজে গিয়েছিল সে আমাকে ফোন‌ দিয়ে বলে আপনার ছেলের অবস্থা ভালো না।‌ জলদি ঢাকা আসেন। ঢাকায় গিয়ে দেখি আমার ছেলের কোনো বোধ‌ জ্ঞান নেই। তার একটি হাত নেই। আরেকটি হাতও কাজ করার মত অবস্থায় নেই। শরিরে আগুনে পোড়ার দাগ।

মিজানুর রহমান আরও বলেন,ওই মূহুর্তে আমি কি করবো না করবো কিছুই ভাবতে পারিনি।‌ আমি বাড়িতে রানার মাকে ফোন‌ দেই। সে গরু,ছাগল বিক্রী করে, মানুষের কাছে ধার দেনা করে আমাকে টাকা পাঠাতে থাকে। আমি সে টাকা  দিয়ে রানার চিকিৎসা চালিয়ে যাই। ধারদেনা ও বাড়িতে যা কিছু ছিল সবমিলিয়ে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ঢাকায় রানার চিকিৎসার জন্য খরচ করি। কিন্তু তারপরও সে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়নি। এখন তাকে আবারও ডাক্তার দেখাতে হবে,ওষুধ কিনার আর কোনো উপায় নেই আমার।

এবিষয়ে আহত রানার মা সাবিনা ইয়াসমিন বলেন,'রানার বাবা আমাকে ফোন দিয়ে বলে ছেলের এমন অবস্থা। আমরা সবাই তো কেঁদে ব্যাকুল। ওইদিনে আমি বাড়িতে থাকা গরু-ছাগল বিক্রি করে রানার চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠিয়ে দেই। আবার ওর বাবা ফোন‌ দিয়ে বলে আরও টাকা লাগবে। তখন মানুষের কাছ থেকে ধার‌ দেনা করে টাকা পাঠিয়ে দেই। এখন আমরা কি খাবো, কিভাবে চলবো, ধার দেনার টাকা কিভাবে শোধ করবো তার কোনো ব্যবস্থা নাই। আবার রানাকে ডাক্তার দেখাতে হবে,ওষুধ কিনতে হবে সে চিন্তায় আমাদের চোখের ঘুম হারিয়ে গেছে। রানার মা আরও বলেন,'আমার সন্তান তিনমাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। আন্দোলনে আমার ছেলে একটি হাত নষ্ট হয়ে গেলো এখন পর্যন্ত কেউ একটু খবরও নিল না। আমার ছেলে বেঁচে আছে, কি মরে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোনো সাহায্য সহযোগিতাও করা হয়নি। আমাদের আর কোনো চাওয়া পাওয়া নাই।সরকার যেনো আমার ছেলের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।


রানার প্রতিবেশী হাছানুর রহমান, রাশেদুজ্জামান রাশেদ ও ফাতেমা বেগম জানান,ছেলের পিছনে রানার পরিবার সব কিছু শেষ করে দিয়েছে। এখন তারা যে তিনবেলা খাবে,ছেলের চিকিৎসা করাবে, ঔষুধ কিনবে এরকম আর কোনো সামর্থ্য নাই তাদের। প্রতিবেশী হিসেবে সরকারের কাছে দাবি রানার সুচিকিৎসা ও তাদের যেনো একটু আর্থিক সহায়তা করা হয়।

এবিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল হক বলেন,'আমি যতদূর জানি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে আহতদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। সেখানে যোগাযোগ করলে রানার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে