তাপপ্রবাহে এবার বোরো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। দেশে অনাবৃষ্টি ও তাপমাত্রা বাড়ায় বোরো ধানে ব্লাস্টের ঝুঁকি বাড়ছে। আর ব্লাস্ট হয়ে গেলে বৃষ্টির পরও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন ধানের চিটা বাড়বে। সেজন্য আগাম ব্যবস্থা হিসেবে ওষুধ ছিটানো জরুরি। আবার কালবৈশাখী ঝড় হলেও ধানগাছ হেলে পড়তে পারে। তাতে গাছের পাতা ঝরা রোগ দেখা দিতে পারে। বোরো মৌসুম থেকেই দেশের ধান উৎপাদনের সবচেয়ে বড় জোগান আসে। এ বছর ২ কোটি ২৬ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর এবার ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হবে। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৪৬ টন। আবাদকৃত জমিতে ধানের শীষ ধরতে শুরু করেছে। কিন্তু অনাবৃষ্টি ও তীব্র তাপপ্রবাহে বোরো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা বাড়াচ্ছে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশের কৃষি অনেকটাই প্রকৃতিনির্ভর। বিগত কয়েক মাস ধরেই দেশে বৃষ্টিপাত নেই। আর তাপমাত্রাও ক্রমাগত বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে দেশের অধিকাংশ এলাকায় মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করার কথা বলা হয়েছে। এখন রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা বিভাগসহ দিনাজপুর, সৈয়দপুর, ফেনী, মৌলভীবাজার, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। গ্রীষ্মের শুরুতেই এমন তাপপ্রবাহ বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করেছে। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধানের ফলন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) পক্ষ থেকে এরই মধ্যে তাপপ্রবাহ থেকে ধান রক্ষায় আগাম সতর্কতা দিয়ে বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে তাপপ্রবাহের কারণে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জেলার একটি তালিকাও দেয়া হয়েছে। ওই জেলাগুলো হলো টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও যশোর।
সূত্র জানায়, তাপপ্রবাহের কারণে ধানের ক্ষতি রোধে জমিতে সর্বদা ৫-৭ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখা প্রয়োজন। জমিতে যাতে কোনোভাবেই পানির ঘাটতি না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। কারণ তাপপ্রবাহে ধানের শীষ ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় আশঙ্কা তীব্র। তবে বোরো জমি ওই রোগে আক্রান্ত হলে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই ওষুধ স্প্রে করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কারণ ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণু ধান গাছের যেকোনো অবস্থায় আক্রমণ করতে পারে। ওই রোগে প্রথমে পত্রফলকে অতি ছোট ডিম্বাকৃতি দাগ পড়ে। ওই দাগের মাঝামাঝি অংশ প্রশস্ত হয়। বড় দাগগুলোর কেন্দ্রভাগ ধূসর বর্ণের হয়। তাতে পাতা মরে যেতে পারে। ব্লাস্ট রোগ ধান গাছের কাণ্ডের গিঁটেও আক্রমণ করতে পারে। গিঁট পচে গিয়ে কালচে হয় এবং সহজেই ভেঙে যায়। তাছাড়া ছড়া বা শীষের গোড়াও আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত অংশ কালচে হয়ে ভেঙে যেতে পারে, তাকে বলে শীষ ব্লাস্ট। অধিক মাত্রায় নাইট্রোজেন সার এবং বাতাসের আর্দ্রতা ওই রোগের প্রকোপ বাড়ায়। তাছাড়া রাতে ঠাণ্ডা, দিনে গরম ও সকালে শিশির পড়া ওই রোগের প্রকোপ বাড়ায়। মাঠে ওই রোগের আক্রমণ ব্যাপক হলে ধান গাছ পুড়ে বসে যাওয়ার মতো হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ওই রোগ প্রতিরোধে জমিতে সবসময় পানি রাখার পরামর্শ দিয়েছে। দেশে বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বোরোর উৎপাদন ছিল ২ কোটি ১০ লাখ টন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৭ লাখ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি ১ লাখ টন ও ২০২০-২১ অর্থবছর ১ কোটি ৯৮ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়।
সূত্র আরো জানায়, তাপমাত্রা আরো বাড়লে বোরো ধানে চিটা হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। যা সার্বিক উৎপাদনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। আর বলাস্ট হয়ে গেলে বৃষ্টি হলেও তা ছড়িয়ে পড়বে। আগাম ব্যবস্থা হিসেবে ট্রুপার বা নেটিভো স্প্রে করা প্রয়োজন। আর বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। তাতেও ধান গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গাছ হেলে পড়তে পারে। তখন পাতা ঝরে পড়তে পারে। তবে ভালো বৃষ্টির পর তাপমাত্রা কমে এলে ঝুঁকিও কমে আসবে। কিন্তু দীর্ঘ খরায় এবার ঠিকভাবে সেচও দেয়া যাচ্ছে না। কারণ একদিকে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বেশি। বালাইনাশকের দামও কয়েক গুণ বেশি। তাই তা খুব বেশি ব্যবহার করা যায়নি। সারের দাম বেশি থাকায় বেশি ব্যবহার হয়নি। তাই ব্লাস্ট হলে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
এদিকে কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপপ্রবাহ ব্লাস্ট হওয়ার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। ব্লাস্ট বোরোর পাশাপাশি আমনেও হয়ে থাকে। এটা গমেও দেখা যায়। তবে সময়মতো ওষুধ দিতে পারলে ফলনের তেমন ক্ষতি হয় না।
অন্যদিকে সার্বিক বিষয়ে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো ওবায়দুর রহমান মন্ডল জানান, এটা নিয়ে কৃষি বিভাগ সতর্ক আছে। কৃষকদের সচেতন করা হচ্ছে। গ্রামের প্রতিটি ব্লকে কাজ করা হচ্ছে। এখনো ব্যাপকভাবে ব্লাস্টে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। আর তেমন কোনো পরিস্থিতি হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।