ঢাকা একদিকে যেন আধুনিকতার প্রতীকÑআকাশচুম্বী দালান, চলমান মেট্রোরেল, প্রযুক্তির অগ্রগতি; অন্যদিকে, গভীর রাতে এ শহর যেন এক আতঙ্কের নাম। নাগরিক জীবনের যে ঘুম গভীর হওয়ার কথা, সে ঘুম এখন ভাঙছে ভয়াবহ চুরি, ছিনতাই, আর ডাকাতির শব্দে। এক সময়ের ‘জেগে থাকা শহর’ এখন ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অপরাধীর হাতে তুলে দিচ্ছে নিয়ন্ত্রণের চাবি। সম্প্রতি রাজধানীর মুগদা, সাভার, বাসাবো, মিরপুর কিংবা পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘটে যাওয়া চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনাগুলো যেন দিনের পর দিন এ বাস্তবতাকেই তুলে ধরছে। এমনকি চলন্ত বাসেও অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের নগদ টাকা, মোবাইল ও স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ১১ এপ্রিল সাভারে মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দুটি চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা তারই উদাহরণ। রাস্তায় হেঁটে চলা মানুষ থেকে শুরু করে নিজের বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা পরিবারÑকেউই এখন আর নিরাপদ নয়। নগরবাসীর আশঙ্কা সত্যিই যুক্তিযুক্ত। রাতে ১১টার পর থেকেই অনেক পুলিশ বক্স ফাঁকা পড়ে থাকে, টহলের তৎপরতা কমে যায়, এমনকি চেকপোস্টগুলোতেও দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগ উঠছে। আর এই শূন্যতা ও শৈথিল্যের সুযোগ নিচ্ছে সশস্ত্র অপরাধীরা। তারা কখনো প্রাইভেটকার, কখনো মাইক্রোবাস, আবার কখনো মোটরসাইকেলে এসে হানা দিচ্ছে বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা বাসে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসছে মারধর, এমনকি প্রাণহানিও। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অপরাধে জড়িতদের বড় একটি অংশ মাদকাসক্ত। নেশার টাকা জোগাড় করতে না পেরে তারা অপরাধের পথ বেছে নিচ্ছে। আর মাদক পাচার ও সরবরাহ বন্ধে ব্যর্থতা, অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় না আনা, সমাজে ভয়ের সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এসব সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। তাছাড়া একে অন্যের বিপদে এগিয়ে না আসার মানসিকতা অপরাধীদের সাহস বাড়িয়ে তুলছে। র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে টহল ও গোয়েন্দা নজরদারির কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নাগরিকদের ভাষ্য, চুরি-ডাকাতির পর থানায় গিয়ে মামলা করতে গেলেও নানা ধরনের হয়রানি ও অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়। অনেকে আবার ভয়ে বা হতোদ্যম হয়ে মামলাই করেন না। ফলে অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঢাকা এখন এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে রাত মানেই আতঙ্ক, ঘর মানেই আর নিশ্চিন্ত আশ্রয় নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখন শুধুই তাৎক্ষণিক তৎপরতায় নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি, পরিকল্পিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং সমন্বিত অভিযানে যেতে হবে। প্রতিটি অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিটি নাগরিককে নিরাপত্তার আস্থা ফিরিয়ে দিতে হবে। রাজধানী ঢাকাকে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে বসবাসযোগ্য করতে চাই, তবে রাতের অন্ধকারে যেসব দুঃসাহসী অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এখনই কঠোর অবস্থান নিতে হবে। নইলে একসময় এ নগরীতে দিন-রাতের পার্থক্য বলে কিছুই থাকবে নাÑচারপাশে থাকবে শুধু ভয়, সন্দেহ, আর হাহাকার।