সাতকানিয়া - লোহাগাড়া এলাকায় বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে ক্ষমতার অবৈধ ব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা ব্যক্তিবর্গের অবৈধ সম্পদের সন্ধানে জোরালো পদক্ষেপ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ লক্ষ্যে দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক এমরান হোসেনকে প্রধান করে গত রবিবার তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধানী দল গঠন করা হয়েছে।
দুদক চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক সুবেল আহমদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সাতকানিয়া - লোহাগাড়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী, তাঁর স্ত্রী রিজিয়া রেজা, শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, লোহাগাড়া থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ শাহজাহান ও মোহাম্মদ রাশেদ, লোহাগাড়া উপজেলার সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু নছর মুহম্মদ হাছান, ছাত্রলীগ লোহাগাড়া উপজেলার সাবেক সভাপতি এইচ এম গণি সম্রাট, লোহাগাড়া উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন, উপজেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হকসহ চব্বিশ জনের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জণের অভিযোগ আসায় উক্ত বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধানী দল গঠন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আবু রেজা নদভী কর্ম জীবনের শুরুতে একটি কওমী মাদরাসায় মাত্র সাত শত টাকা বেতনে চাকরি করতেন বলে জানা যায়। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতা মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরীর মেয়ে রিজিয়াকে বিয়ে করার পর তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। শ্বশুরের সুবাধে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশ বিভাগে চাকরি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড কালেকশন টিমের সাথে আরব দেশে সফর শুরু করেন। পরে নিজের পিতার নামে গড়ে তোলেন আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন নামক একটি সংস্থা। এই ফাউন্ডেশনের নামে আরব দেশগুলো হতে মসজিদ তৈরীর নামে নিয়মিত ডোনেশন সংগ্রহ করতে থাকেন। দেশে মসজিদ তৈরীর পাশাপাশি নিজের এবং পরিবারের নামে সম্পদও বৃদ্ধি করতে থাকেন তুফানের গতিতে। এক পর্যায়ে জামায়াতের সাথে বিরোধ দেখা দিলে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়ে সাতকানিয়া - লোহাগাড়ার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান। ২০২৪ সালের জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিজ দলের সাতকানিয়া উপজেলা সভাপতির কাছে পরাজিত হন।
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আবু রেজা নদভী সাতকানিয়া - লোহাগাড়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। একের পর মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলায় জড়িয়ে এ অঞ্চলের বিএনপি - জামায়াতের নেতা-কর্মীদেরকে ঘরছাড়া করেন। অনেকে হন কারান্তরীণ। অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হাত, পা কেটে পঙ্গু বানিয়ে দেয়া হয় অনেককে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী চট্টগ্রাম মহানগর এবং উত্তর চট্টগ্রামেও নিজের ক্ষমতার দাপট ও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন।
জামায়াত নেতাদের দ্বারা সীতাকুন্ডের কুমিরায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) জোর পূর্বক দখল করে নিয়েছিলেন আবু রেজা নদভী।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও সাবেক সংসদ সদস্য আ. ন.ম শামসুল ইসলামকে সরিয়ে আইআইইউসি'র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নেন তিনি। চাকুরিচ্যুত করেন অনেককে। পরে আবার নিয়োগ দেন নিজ পছন্দের লোকজনকে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেলে তিনি ওই পদ হারান।
নদভী ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টের অধিভুক্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ‘আইআইইউসি টাওয়ার’ এর দশ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। দুদক সেই অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে।
গত জানুয়ারিতে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নদভীর বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। এরপর গত ১২ মার্চ অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদক উপ-পরিচালক সুবেল আহমেদ কারাবন্দী নদভীকে আদালতের অনুমতিতে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে নদভীকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। সেখানে ঢাকার একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামে হওয়া মামলায় নদভীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি এখনও কারাবন্দী। নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা ৫ আগস্টের পর সৌদি আরব পালিয়ে গেছেন বলে তার ফেসবুক পোস্ট মারফত জানা যায়।