১৬ বছরেও চালু হয়নি স্যালাইন কারখানা

এফএনএস (টিপু সুলতান; কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ) :
| আপডেট: ৫ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:৩৫ পিএম | প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০২:৫৯ এএম
১৬ বছরেও চালু হয়নি স্যালাইন কারখানা

কারখানাটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ১৬ বছর আগে। অথচ তা পড়ে আছে অযত্ন, অবহলোয়। ভবনের চারপাশে ছেয়ে গেছে ঝোপ-ঝাড়ে। বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ময়লা-আর্বজনার স্তুপ। ফাটল দেখা দিয়েছে ভবনের দেয়ালে। অথচ কারখানাটি রক্ষা বা চালু করতে স্বাস্থ্য বিভাগের কোন উদ্যোগ নেই। এমন চিত্র ওরাল স্যালাইন কারখানার। ঝিনাইদহ ৬ উপজেলার মানুষের পানি শূণ্যতা পূরন কিংবা ডায়রিয়ার চিকিৎসার অনুসঙ্গ হিসেবে শহরের মদন মোহন পাড়ায় নির্মাণ করা হয় ওরাল স্যালাইন কারখানা। ঝিনাইদহ ওআরএস স্যালাইন ফ্যাক্টরি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ফ্যাক্টরিটি নির্মাণ করে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ২০০৫ সালের ২২ অক্টোবর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট। এতে মোট ব্যয় হয় ৯৮ লাখ ৩৪ হাজার ১৮৯ টাকা। নির্মাণের পর এভাবেই পড়ে আছে। হয়নি যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও লোকবল নিয়োগ। দেড় যুগেও সৃষ্টি করা হয়নি পদ। অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে অবকাঠামো,যন্ত্রাংশসহ আসবাবপত্র।স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, অনুমোদন না পাওয়ায় উৎপাদন শুরু হয়নি।ঝিনাইদহ সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) এর সভাপতি আবু তাহের জানান, পানি শূন্যতা পূরন কিংবা ডায়রিয়া রোগে নিতান্তই প্রয়োজন হয় ওরাল স্যালাইন। ভিতরে বিদ্যুতের তার, ফ্যান লাইট এর ব্যবস্থা থাকলেও বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে সেগুলোও নষ্ট হতে চলেছে। এমন অবস্থায় পড়ে থাকলেও ফ্যাক্টরিটি চালু করতে নেই স্বাস্থ্য বিভাগের কোন উদ্যোগ। জনস্বাস্থ্যের কথা ভেবেই যদি ফ্যাক্টরিটি তৈরি হয় তাহলে কেন চালু হচ্ছে না। সেই শুরু থেকেই অযত্ন, অবহেলায় পড়ে আছে স্যালাইন ফ্যাক্টরি। ভবনের চারপাশে ভরে গেছে ঝোপ-ঝাড়ে, ভিতর ও বিভিন্ন কক্ষে সৃষ্টি হয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। ভেঙে যাচ্ছে দরজা-জানালা। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দ্রুত হন্তক্ষেপ কামনা করছি। এ স্যালাইন ফ্যাক্টরি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল, উৎপাদিত স্যালাইন ঝিনাইদহ জেলার ও আশপাশের জেলায় সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলোতে সরবরাহ করা। এতে দরিদ্র মানুষ উপকৃত হতো। তবে তা এখন পর্যন্ত চালুই হয়নি।স্থানীয় রাশেদুল ইসলাম বলেন, এত বছরেও জানিনা এখানে কোন স্যালাইন ফ্যাক্টরি আছে। কোনদিন কোন কার্যত্রম চোখে পড়েনি। তাই বিষয়টি সম্পর্কে জানা নেই।জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক যুবক বলেন, কানাখানটি চালু না হওয়ায় আজ পর্যন্ত এখানে কারো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। এভাবে বন্ধ পড়ে আছে। কারখানাটি চালু হলে ৬ উপজেলার  সহ আশপাশের মানুষ স্যালাইন সংকট থেকে মুক্তি পেত।রুবেল নামে আরেক যুবক বলেন, কারখানাটি বন্ধ পড়ে থাকার কারণে এখানে নিয়মিত মাদকের আড্ডা বসে।নির্মাণের দীর্ঘদিন পরও চালু হয়নি ওরাল স্যালাইন ফ্যাক্টরি। ফলে খাবার স্যালাইনের সুবিধা থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ, তেমনি অযত্ন-অবহেলায় ঝোপঝাড় আর আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে ফ্যাক্টরিটি।স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে একটি প্রকল্পের আওতায় পুরোনো শহরের হাসপাতালের পাশে ঝিনাইদহ ওরাল স্যালাইন ফ্যাক্টরি নির্মাণকাজ শুরু হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ফ্যাক্টরিটি হস্তান্তর করা হয়। কথা ছিল এ ফ্যাক্টরিতে স্যালাইন তৈরি হবে। এ স্যালাইন আশপাশের জেলাগুলোর সরকারি হাসপাতাল গুলোতে সরবরাহ করা হবে। ব্যবহৃত হবে রোগীদের চিকিৎসায়। বিশেষ করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো লোকবল নিয়োগ হয়নি। সরবরাহ করা হয়নি স্যালাইন তৈরির যন্ত্রপাতি। ফলে ফ্যাক্টরিসহ ভবনটি এখন কোনো কাজে আসছে না। জেলার সিভিল সার্জন ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ জানান, অনেক আগে স্যালাইন ফ্যাক্টরিটি নির্মাণ করা হয়। লোকবল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করায় তা চালু হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা জানান, যশোরে একটি স্যালাইন ফ্যাক্টরি আছে। সে কারণে পাশের জেলা ঝিনাইদহে আরেকটি ওরাল স্যালাইন ফ্যাক্টরি চালুর যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করছেন না কর্তৃপক্ষ। জেলার চাহিদা পূরণ করতে এখন যশোরের কারখানা থেকে স্যালাইন আনা হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে গেলে এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি (ইডিসিএল) থেকে কিনে তা পূরণ করতে হচ্ছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটি চালু হলে ঝিনাইদহসহ খুলনা বিভাগের অন্য জেলায়ও স্যালাইন সরবরাহ করা যেত। শহরের চাকলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারুল কাদের বলেন বিএনপি নেতা মসিউর রহমান প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু জনকল্যাণ মূলক প্রতিষ্ঠানটি আজও আলোর মুখ দেখল না। কেন চালু করা হলো না প্রতিষ্ঠানটি এটা জনমনে প্রশ্ন দেখা দেখা দিয়েছে ? উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় চত্বরে ১০ শতাংশ জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে সরকারি খাবার স্যালাইন কারখানা। ২০০৫ সালের ২২ অক্টোবর এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি মসিউর রহমানসহ তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ২০০৮ সালের ১১ আগস্ট শেষ হয় দ্বিতল ভবনের নির্মাণকাজ। এতে ব্যয় হয় ৯৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। সাবেক এমপি প্রয়াত মসিউর রহমানের ছেলে ডাঃ ইব্রাহিম রহমান বাবু বলেন, শুধু রাজনৈতিক কারণে কারখানাটি চালু হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এ ধরনের সরকারি প্রকল্প যেন মুখ থুবড়ে না পড়ে, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ থাকবে। সেই সঙ্গে দ্রুত যেন কারখানাটি চালু করা হয়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় পড়ে বন্ধ না থাকে, সেদিকেও মন্ত্রণালয় গুলোকে খেয়াল রাখতে হবে। দেখা গেছে, উদ্বোধনী কোনো ফলক নেই। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় দক্ষিণ ও পূর্বপাশে সৃষ্টি হয়েছে জঙ্গল। ভেতরের সম্মেলন কক্ষটি সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সম্মেলন কক্ষ এবং আরেকটি কক্ষ ইপিআই টিকাদান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। করোনাকালে এটি করোনা টিকাদান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। কয়েক বছর আগে আসা শক্তিশালী থ্রি ফেইজ জেনারেটর পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার পথে। দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষ স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন কক্ষ ও সিঁড়িতে জমেছে ময়লা। বিড়ি-সিগারেটের অংশও পাওয়া গেছে। কর্মকর্তারা জানান, সদর হাসপাতালে মাসে ১০ হাজার ৪০০ প্যাকেট, সদরের বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ১০ হাজার, শৈলকূপায় ২১ হাজার ৭৭০, কালীগঞ্জে ১৮ হাজার ৬০০, মহেশপুরে ১৫ হাজার, কোটচাঁদপুরে ১২ হাজার ৪০ এবং হরিণাকুন্ডু উপজেলায় ১৪ হাজার ৮৮৫ প্যাকেট খাবার স্যালাইন প্রয়োজন হয়। সরকারি শিশু হাসপাতালে মাসে চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৫৩৭ প্যাকেট। সব মিলিয়ে জেলায় মাসে ১ লাখ ৪ হাজার ২৩২ প্যাকেটের চাহিদা রয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মিথিলা ইসলাম বলেন, অনুমোদন না দেওয়ায় এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি কারখানাটি। এ বিষয়ে অনেকবার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছি। তবে দৃশ্যমান কোন কাজ হয়নি। কারখানাটি চালু করতে যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে