পরিচালনা পর্ষদের নজরদারির অভাব, লাইব্রেরিয়ান না থাকা এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ১৪ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ১৭১ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে থাকা এ লাইব্রেরি বিভিন্ন সময় সচল করার দাবি উঠলেও তাতে কর্ণপাত করেনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রিটিশ সরকারের সময় ১৮৫৪ সালে বরিশাল এনেক্স ভবনের পাশে ১৭ শতক জমির ওপরে প্রতিষ্ঠা করা হয় বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। পরে ১৯৮৫ সালে ১৪ হাজারের বেশি বই সমৃদ্ধ লাইব্রেরিটি নগরীর বান্দ রোডে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ৫৮ শতক জমির ওপর নির্মাণ করা হয় একতলার পাবলিক লাইব্রেরি ভবন। সে সময় প্রতিদিন গড়ে তিনশ’ মানুষ লাইব্রেরিতে বই পড়তে আসতেন। এরপর নানা সমস্যার কারণে ঐতিহাসিক গণগ্রন্থাগারটি ২০০৪ সালে বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে লাইব্রেরিটি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেসব উদ্যোগ ভেস্তে যায়। সূত্রমতেম লাইব্রেরিটির কার্যক্রম সচল করার জন্য সর্বশেষ ২০১২ সালের প্রথমদিকে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠণ করা হয়। সরকারি উদ্যোগে ভালভাবে প্রতিষ্ঠানটি চালু থাকার জন্য পদাধিকার বলে কমিটির সভাপতি করা হয় জেলা প্রশাসককে। ওইসময় লাইব্রেরির ১১শ’ জন সদস্য ছিলেন। এরমধ্যে ছয়শ’ জন ছিলেন আজীবন সদস্য। বাকিরা সাধারণ সদস্য ছিলেন। তবে এর কয়েক মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে অদ্যবর্ধি প্রতিষ্ঠানটিকে সচল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। সরেজমিনে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ লাইব্রেরি ভবন। ভবনের দেয়াল ও ছাদের বিভিন্নস্থান থেকে খসে পড়েছে পলেস্তারা। বইয়ের তাকগুলো তালাবদ্ধ। এর অধিকাংশ বই নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, লাইব্রেরির নিরাপত্তা প্রহরী নেই। পরিত্যক্ত লাইব্রেরি ভবন ও এর আশপাশের এলাকা মাদকসেবীদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া এখানে রাতে অনৈতিক কর্মকান্ড চলার অভিযোগ রয়েছে। পাবলিক লাইব্রেরির এমএলএসএস শহিদ গাজী বলেন, একসময় দিনে এখানে কমপক্ষে তিনশ’ লোক বই পড়তে আসতেন। এখন সেই পরিবেশ নেই। তাই পাঠকও আসেন না। ১৪ বছর ধরে পাঠকের আশায় আছি। ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে এখনো আশায় আছি, লাইব্রেরিটি আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। লাইব্রেরি অঙ্গনে ফিরে আসবে প্রাণচাঞ্চল্য। এ ব্যাপারে জাতীয় কবিতা পরিষদ বরিশাল শাখার সভাপতি তপংকর চক্রবর্তী বলেন, লাইব্রেরির সভাপতি জেলা প্রশাসক। লাইব্রেরি পুনরায় চালু করার জন্য আগের জেলা প্রশাসকদের কাছে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা আগ্রহ দেখাননি। বর্তমানে যে জেলা প্রশাসক আছেন তার কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। আমি মনে করছি, বরিশালের অন্য যেকোনো উন্নয়নকাজে হাত দেওয়ার আগে তিনি পাবলিক লাইব্রেরিটি চালু করবেন। ঐতিহ্যবাহী এ লাইব্রেরির সদস্য লেখক ও গবেষক আনিচুর রহমান খান স্বপন বলেন, ভারত ও বাংলায় প্রথম যে চারটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তার একটি হলো বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি। অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই লাইব্রেরিটি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। অব্যবস্থাপনার কারণে লাইব্রেরিটি এখন সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত পরে রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে পাবলিক লাইব্রেরিটি চালুর দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে লাইব্রেরিতে থাকা বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ার মতো পরিবেশ সৃস্টি করা হলে নতুন নতুন পাঠকের সৃস্টি হবে। আশা করছি, বর্তমান প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরি পুনঃউজ্জীবিত করা হবে। এ ব্যাপারে বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি নিয়ে সবার মাঝে আগ্রহ রয়েছে। আমরাও চাই লাইব্রেরিটি টিকে থাকুক। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জনবল নিয়োগ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।