চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে মিলারদের আধিপত্য

এফএনএস : | প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ০৭:৩১ পিএম
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে মিলারদের আধিপত্য

বাংলাদেশের ধান ও চালের বাজার দীর্ঘদিন ধরেই একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে মিলাররা। সরকারি মজুদ সক্ষমতা যেখানে মাত্র ২২ লাখ টন, সেখানে মিলারদের মজুদ সক্ষমতা প্রায় এক কোটি টন। বছরের তিনটি মৌসুমে তারা গড়ে ৩৪ লাখ টন চাল মজুদ করে। ফলে বাজারের নিয়ন্ত্রণ কার্যত তাদের হাতেই চলে গেছে। সরকারি নীতির দুর্বলতা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের অভাবে মিলাররা ধান-চালের দামে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। কৃষকরা উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মিলার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের ফলে চালের বিক্রয়মূল্যের ৭১ শতাংশই তাদের পকেটে যায়, আর কৃষক পান মাত্র ২৯ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও ইফপ্রির গবেষণা বলছে, ভারত ও চীনের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম সবচেয়ে কম পান। বাংলাদেশে মিলারদের চাল সংগ্রহের অন্যতম মাধ্যম হলো ফড়িয়ারা। ৬২ শতাংশ চালকল মালিক ফড়িয়াদের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করে, ফলে কৃষকরা সরাসরি তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে পারেন না। ভারত ও চীনের চিত্র ভিন্ন; সেখানে অধিকাংশ মিলার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে, যার ফলে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশে মিলাররা বাজারের সিন্ডিকেট তৈরি করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে বড় ধরনের মূল্য পার্থক্য সৃষ্টি করছে, যা কৃষকদের আয় কমিয়ে দিচ্ছে। ধান চাষ লাভজনক নয় এমন বাস্তবতায় কৃষকরা বিকল্প ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধান চাষে কৃষকের লাভ মাত্র ৭ থেকে ২৯ শতাংশ, যেখানে মাষকলাই, মুগ, রসুন ও আদার মতো ফসল তুলনামূলকভাবে বেশি লাভজনক। ফলে কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, যা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। অতিরিক্ত মজুদ ক্ষমতা ও চাল সংরক্ষণ সুবিধার কারণে মিলাররা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, যা চালের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার মূল কারণ হলো মিলারদের এই বাড়তি মজুদ সুবিধা। এক দশকের ব্যবধানে অটোরাইস মিলগুলোর উৎপাদন ও মজুদ ক্ষমতা অনেক বেড়েছে, যার ফলে কৃষকরা একদিকে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভোক্তারা উচ্চমূল্যে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এ সংকট নিরসনে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। সরকারি পর্যায়ে চাল মজুদ ক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও মিলারদের বাজার নিয়ন্ত্রণ কমাতে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষকদের সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, সরকারি খাদ্যশস্য কেনার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যাতে কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম পেতে পারে। সরকার যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে চালের বাজার আরও বেশি সংকটাপন্ন হবে। কৃষকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে মিলারদের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙতে হবে এবং ধানের ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW