সংবিধান তার ন্যায্যতার পক্ষে যে যুক্তি হাজির করে তা হলো, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন।’ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ খেদিয়ে নিজেদের অভিপ্রায় ঘোষণা করেছে। গণবিপ্লব গণইচ্ছার যে সূত্রসমূহ নিয়ে হাজির হয়, সেটাই বিদ্যমান পরম অভিপ্রায়। সেই অভিপ্রায়ই প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন রচনা করবে। সাবেকী সংবিধানের ধারাবাহিকতা কিংবা সাংবিধানিক শূন্যতার যুক্তি এখানে চালক হতে পারে না। বরং বিপ্লব বা অভ্যুত্থান যে গাঠনিক ন্যায্যতা ও ক্ষমতা ধারণ করে, তার মৌলিক দাবি হলো রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের পরিগঠন ও আইনি বিনির্মাণ। যে সংবিধান ব্যবহার করে ‘ফ্যাসিস্ট’ রেজিম জারি থেকেছে, বিপ্লবের পর সেই সংবিধান গুরুত্ব হারিয়েছে। বিপ্লব ছিল এই রেজিমকে প্রত্যাখ্যানের গণঘোষণা, যা সংবিধানের আওতায় ঘটেনি। ফলে বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ এই সংবিধানের কর্তৃত্ব কবুল করবে কোন গণইচ্ছার বলে? বস্তুত এই সংবিধানের কর্তৃত্বের অর্থ হলো বিগত রেজিমকে জারি রাখা এবং বিপ্লবীদের জন্য ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত করা। নাগরিকদের পরম অভিব্যক্তি যে সংবিধান, সেটি কিন্তু নাগরিকদের ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। নাগরিকরা বরং প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাহী বিভাগের প্রজা হয়ে আছেন।
ফলে সংস্কারের গণদাবি বিপ্লবের মধ্যে প্রতিফলিত। তবে টেকসই সাংবিধানিক সংস্কারের স্বার্থে আমাদের সব গণপ্রতিনিধিত্বশীল পক্ষকে একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে উপনীত হতে হবে। ন্যূনতম ঐকমত্য নিশ্চিত করেই সংস্কার সম্পন্ন হতে হবে। যে কমিশন গঠিত হয়েছে, সেটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তাবনা হাজির করবে। সেটি বলবৎ করার জন্য জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সাংবিধানিক অ্যাসেম্বলি গঠন করতে হবে। সেই অ্যাসেম্বলি বিস্তারিত প্রক্রিয়া এবং বিতর্ক-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংবিধানে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখনসমূহের চূড়ান্ত ন্যায্যতা দেবে। সংস্কারকৃত সংবিধানের ভিত্তিতে হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এটাই সম্ভবত হতে পারে সংস্কারের গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া। যদিও কিছু প্রধান রাজনৈতিক দল চাইবে, কমিশন কেবল সংস্কারের প্রস্তাবগুলো তৈরি করুক। পরে নির্বাচিত সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করুক। কিন্তু তাদের দ্বারা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি বিপ্লবের আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করবে, এর নিশ্চয়তা কোথায়? তার চেয়ে বরং সাংবিধানিক অ্যাসেম্বলি গঠনে সবার ঐকমত্য বিপ্লবের অভিপ্রায়ের অনুকূল। সাধারণ বিচারে সংবিধানে পরিবর্তন ও সংস্কারের জরুরি ক্ষেত্র অনেক। কয়েকটা ক্ষেত্র নির্দেশ করা যেতে পারে।
১. সংবিধানের শুরুতেই আছে- বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। কুরআনের আয়াতটি ভুলভাবে লেখা হয়েছে। আসলে তা হবে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এর অর্থ হিসেবে লেখা হয়েছে- দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহের নামে। এই তর্জমা চলনসই হলেও বাক্যটি সঠিক নয়। হবে- দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম যেহেতু কুরআনের আয়াত, তাই তা শুরুতে আরবিতে লিখে ব্র্যাকেটে বাংলায় লিখে অর্থ উল্লেখ করাই উত্তম হবে।)
২. সংবিধানের প্রস্তাবনায় দাবি করা হয়েছে, ‘যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল’, সেগুলো হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই দাবি ইতিহাসসম্মত নয়। প্রথমত জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম একমাত্র একাত্তরের সংগ্রাম নয়। আবার একাত্তরের সংগ্রামের কোনো ঘোষিত আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রামাণ্যতা নেই। বরং সেটা হচ্ছে ১৯৭২ সালে প্রণীত বয়ান। প্রকৃত অর্থে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শে। এটিই সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখের সুপারিশ করি।
৩. সংবিধানের প্রস্তাবনায় শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ একটি মতাদর্শিক প্রত্যয়, বাংলাদেশের সমাজ জীবন যার আকাক্সক্ষা করে না। বরং আমাদের দরকার শোষণমুক্ত সমাজ, যেখানে সব নাগরিকের জন্য ন্যায়ের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।
৪. সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে’
এখানে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণকে স্বীকার করা হলেও ক্ষমতার প্রয়োগের মালিকানা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে দেয়া হয়েছে। সংবিধানের চতুর্থ ভাগ থেকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে জনগণের ক্ষমতাকে কারা কিভাবে কতটুকু প্রয়োগ করবেন। বস্তুত সংবিধান বলছে ক্ষমতা জনগণের, কিন্তু তার প্রয়োগের মালিক-মোখতার নির্বাহী বিভাগের ওসিলায় প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতার সেই প্রয়োগ দিন শেষে জনগণের ক্ষমতাকে সমর্থন করে না। পাঁচ বছর পরে একবার ভোট দিয়ে দেবার নাম জনগণের সকল ক্ষমতার মালিকানা নয়। প্রকৃতপক্ষে ধর্মে বিশ্বাসী জনগণ বিশ্বাস করে না যে, জনগণ সকল ক্ষমতার সার্বভৌম মালিক।
৫.অনুচ্ছেদ ৭(১) জানাচ্ছে -
প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।
সকল ক্ষমতার মালিক না বলে আমরা বলব, জনগণ প্রজাতন্ত্রের কর্তাসত্তা এবং প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতা/ন্যায্যতা দানকারী হলো জনগণ। ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতা দানকারী হিসেবে জনগণকে স্পষ্টতা দিতে হবে। এতে রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এটি মনে রাখতে বাধ্য থাকবে যে, জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করলে তা আইনের নামে আপাতত ন্যায্যতা পেলেও ভবিষ্যতে অবৈধ হয়ে যাবে। তাই তারা ফ্যাসিবাদী হওয়া থেকে বিরত থাকবে।
৬. সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। এতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা- এই চার মৌলনীতিকে বাংলাদেশ পরিচালনার মূলসূত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইনের ব্যাখ্যাদানে একে পথপ্রদর্শক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের কাজের ভিত্তি সাব্যস্ত করা হয়েছে। এসব মূলনীতির সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু (ক) বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা অবাংলাভাষী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর পরিচিতি ও অন্তর্ভুক্তিকে উপেক্ষা করে। সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ অবাঙালিসহ সব জনগোষ্ঠীকে স্বস্তি দেবে। ৬ অনুচ্ছেদে জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’র বদলে সব নাগরিক ‘বাংলাদেশী’ হবে, এমন বিধান করা উচিত। বাংলাদেশী হিসেবে বিহারিসহ যেসব অবাঙালি জনগোষ্ঠী এখানকার ন্যায্য বাসিন্দা, তাদের উল্লেখ করতে হবে। (খ) ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের সরকার সংবিধান থেকে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র খারিজ করেছিলেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে সেটি পুনরায় ফিরিয়ে আনে হাসিনা সরকার। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজ বা অর্থনীতি আসলে কী প্রাসঙ্গিকতা বহন করে? যেখানে রাষ্ট্রের সর্বত্র মুক্তবাজার অর্থনীতির চর্চা হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রের মূলনীতি অংশে সংবিধানে বলা হচ্ছে- সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে। (অনুচ্ছেদ-১০)। এখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বদলে ইনসাফভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিশ্চিত করতে হবে।
বস্তুত নাগরিক মধ্যবিত্তের একটি অংশের সমাজতান্ত্রিক লিপ্ততার স্মৃতিতর্পণ ছাড়া আর কোনো মূল্যে সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে মূলনীতির মহিমা দেয়া হচ্ছে, তা অবোধগম্য। এটি বাদ দেওয়া দরকার।
(গ) ধর্মনিরেপেক্ষতা এ দেশে ইসলামোফোবিয়া হয়ে হাজির হয়েছে বৃহত্তর অর্থে। ধর্মীয় ভাবাবেগ ও চর্চার বিরুদ্ধে যা অনবরত স্বৈরাচার জারি রেখেছে- রক্তচক্ষু প্রদর্শন করেছে এবং ইসলামী অনুশীলনকে মার্জিনালাইজ করেছে এবং নানা ক্ষেত্রে অপরাধীকরণ করেছে। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার এই স্বৈরাচারী ব্যবহার জনগণের অন্য সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে।
বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের প্রতি কোনো ধরনের বৈষম্যহীনতাকে নির্দেশ করে। সেটাই মুখ্য এবং এর কল্যাণময় ব্যবহার নিশ্চিত করতে ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে উপযুক্ত শব্দ ব্যবহারের প্রস্তাব করছি। যেমন- ধর্মীয় কারণে বৈষম্যলোপ। যেখানে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় নিপীড়ন ও ধর্মের অপব্যবহারের পথ বন্ধ হবে।
৭. অনুচ্ছেদ ৭০, তথা দলের বিপক্ষে ভোট প্রদানসংক্রান্ত বাধানিষেধ বাতিল করতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদ, কার্যপ্রণালিবিধি এবং স্থায়ী কমিটির ক্ষমতা সংস্কার করে সংসদ কার্যকর করা জরুরি।
৯. পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র আপন বুনিয়াদ মজবুত করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কিছু বিষয়ও ফিরিয়ে এনেছে। রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করেছে। এই সংশোধনীর মাধ্যমেই শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেয়া ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংবিধানে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং জাতির পিতার বদলে জাতির স্থপতিবৃন্দ প্রবর্তন করতে হবে।
১০. অনুচ্ছেদ ১৫-এ মানুষের মৌলিক অধিকারের পুনর্বিন্যাস জরুরি। মানুষ দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত সত্তা হিসেবে যে মৌলিক অধিকার দাবি করে, আমাদের সাংবিধানিক বয়ানে তার প্রতিফলন পূর্ণ নয়। মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক অধিকার ও চাহিদাও নিশ্চিত করতে হবে।
১১. অনুচ্ছেদ ৪ক এ পরিবর্তন আনা দরকার। জাতির পিতা অর্থে ব্যক্তির ছবির বদলে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সব সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোতে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে হবে।
১২. সংবিধানের তৃতীয় ভাগ হলো মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত। যেখানে ঘোষণা করা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে রাষ্ট্র কারো প্রতি বৈষম্য করিবে না, প্রত্যেকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার আছে এবং চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা ইত্যাদি নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এসব স্বাধীনতা থেকে জাতি বৃহত্তর অর্থে বঞ্চিত ছিল ফ্যাসিবাদী আমলে। কেন?
কারণ, সংবিধানে এসব স্বাধীনতাকে বন্দী করা হয়েছে এমন সব পরিভাষার আশ্রয়ে, ফ্যাসিবাদ যাকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করেছে। যেমন- প্রচলিত আইন, নৈতিকতার পাশাপাশি জনস্বার্থে আরোপিত বিধিনিষেধ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি। ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ২৬(৩) যুক্ত করে বস্তুত অনুচ্ছেদ ২৬ এ ঘোষিত মানবাধিকারগুলোকে কথার কথা বানিয়ে দেয়া হয়। ১৮টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে ১৫টিকেই প্রচলিত আইনের নামে বন্দী করা হয়েছে। এসব অধিকার ক্ষমতাসীনদের এখতিয়ার থেকে মুক্ত করতে হবে।
১৩. ভবিষ্যতে মৌলিক বিধানাবলী সংশোধন করতে হলে গণভোটের বিধান রাখতে হবে। কেবল ৭৫% ভোট পেলেই মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন করা যাবে। গত ৫০ বছরে আমরা দেখলাম অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি দল এবং বিরোধী দল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না। এজন্য গণভোটের সুযোগ রাখা খুবই জরুরি। একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কারণে পার্লামেন্টে ৭০ শতাংশেরও বেশি সিট পেয়ে যেতে পারে। তার মানে এই নয় যে জনগণ সব ইস্যুতেই সেই দলকে সাপোর্ট দিয়েছে। তাই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গণভোটের সুযোগ রাখাটা জরুরি।
১৪. অনুচ্ছেদ ১২(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এটা সমস্যা ও অপব্যবহারের অনুকূল। বরং নিষিদ্ধ করা উচিত ধর্মের সহিংসতামূলক অপব্যবহার।
সহিংসতা শব্দটি যোগ করতে হবে। কারণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বিলোপ করার অজুহাত দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জবরদস্তি হাজির হয়।
১৫. অনুচ্ছেদ ১৫ জানাচ্ছে- রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন। কিন্তু কেবল বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক মানের উন্নতি দিয়ে চলবে না। বরং আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক মানের উন্নয়নও জরুরি। এই দিকটি যোগ করতে হবে।
১৬. পার্লামেন্টে বিরোধী দল যেন নিষ্ক্রিয় না থাকে সেজন্য বিরোধী দলের সদস্যদের দিয়ে একটি শ্যাডো ক্যাবিনেট (ংযধফড়ি পধনরহবঃ) তৈরি করার বিধান রাখা এবং সংসদে তাদের কথা বলার বাড়তি সুবিধা দেয়া দরকার। যেন সরকারি দলের পলিসির বিরুদ্ধে বিরোধী দল যুক্তিসঙ্গত উন্নত পলিসি দিতে বাধ্য হয় এবং জনগণ বিরোধী দলের মেধা যাচাইয়ের সুযোগ পায়। (ব্রিটেন এর ওয়েস্ট মিনিস্টার মডেলে এই বিধান রয়েছে)
১৭. আইন, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে বিরোধী দলের সদস্যদের বাধ্যতামূলক মনোনয়ন দিতে হবে। যেন এই মন্ত্রণালয়গুলো নজরদারিত ও জবাবদিহিতায় থাকে।
১৮. পার্লামেন্টে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং পলিসি ডিবেটগুলোতে সেরা ভূমিকা রাখার জন্য এমপিদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা থাকতে পারে। তাহলে সংসদে বিতর্কের মান আরো বাড়বে এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা পার্লামেন্ট জনগণকে ফায়দা দেবে। (ভারতে এর উদাহরণ আছে)
১৯. ইলেকশন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটির প্রধান সংসদীয় বিরোধী দলের মতামতের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া উচিত। বাকি সদস্যদের ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে।
২০. ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে একজন ভোটার দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ই-মেইলে (আমেরিকায় রয়েছে) বা তার জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক যেকোনো কেন্দ্রে ভোট দিতে পারার বিধান রাখা দরকার। এটি হলে কোনো এলাকায় বিশেষ প্রার্থীর যদি অতিরিক্ত প্রভাব ও বিশেষ শক্তি থাকে, সেই প্রভাব কম ক্রিয়াশীল হবে। কারণ ওই এলাকার ভোটার দেশের যেকোনো প্রান্তে থাকা সেন্টার থেকে তার সংসদীয় এলাকার ভোট দিতে পারবে।
২১. বিভিন্ন ইস্যুতে সংসদে ভোটাভুটির ক্ষেত্রে এমপিদের ফ্লোর ক্রসিং করার সুযোগ দিতে হবে। যেন তারা তাদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েও সংসদে ভোট দিতে পারেন এবং এর জন্য যেন তারা বহিষ্কৃত না হয়।
২২. তথ্য জানার অধিকার এবং আকল বা মেধার সংরক্ষণ মৌলিক অধিকার এবং মূলনীতির ভেতর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২৩. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং একই ব্যক্তি দুইয়ের অধিকবার প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, সেই বিধান প্রবর্তন প্রয়োজন।
২৪. ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্র, সরকার ও তার দলকে একাকার করে ফেলে। শেষ অবধি ফ্যাসিস্ট নিজেই নিজেকে রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দেয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে বানায় নিজের লাঠিয়াল। এই পরিস্থিতি যাতে ফিরে না আসে, সেজন্য (ক) যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাকে দলীয় প্রধানের পদ ছাড়তে হবে। (খ) ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা এবং অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩), অনুচ্ছেদ ৫৫, অনুচ্ছেদ ৫৬ (১) অনুচ্ছেদ ৫৮ (২) এবং অনুচ্ছেদ ৭০ প্রধানমন্ত্রীকে যে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়, তাতে পরিবর্তন আনা। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নির্বাহী ক্ষমতার একটা ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো স্থির করতে হবে। (গ) প্রেসিডেন্ট যেহেতু নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগে অংশত অংশীদার, তাই তাকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। (ঘ) বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে। স্বাধীন উচ্চ আদালতের অধীনে থাকবে নিম্ন আদালত। অধস্তন আদালতে নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন ইত্যাদি বিষয় সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্বে থাকবে। এ জন্য গঠন করা যেতে পারে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থাকবে না। (ঙ) হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হওয়ার যোগ্যতা নির্দিষ্ট করতে হবে এবং দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বেচ্ছাচারী ও অদক্ষ নিয়োগকে অসম্ভব করে তুলতে হবে। (চ) ক্ষমতা হস্তান্তরের যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও পুনর্বহাল করতে হবে। (ছ) প্রধানমন্ত্রীকে অভিসংশনের ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
২৫. কৃষকের, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, তাদের রুটিরুজির সুরক্ষার নিশ্চয়তার বিধান সংবিধানে থাকতে হবে। সংবিধানে কর্মসংস্থানের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার-এই বিষয়গুলোকে আরো বিস্তৃত ও সুনির্দিষ্ট করতে হবে।
২৬. অনুচ্ছেদ ২ ক জানাচ্ছে-
প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবে...। এর সাথে যুক্ত করতে হবে যে, ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন পাস করিবে না।
ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক আইন বাতিলের ক্ষমতা থাকবে সুপ্রিম কোর্টের। ইসলামী বিষয়ে আদালত এ ব্যাপারে তিনজন বিশেষজ্ঞ ফকিহের (ইসলামী আইনবিদ) মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেবেন। মুসলিম জনগণের বিশ্বাস ও দাবি হলো মহানবী সা: সর্বশেষ নবী ও রাসূল, এর ঘোষণা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সাথে অঙ্গীভূত। একই সাথে ধর্মপ্রবর্তকদের অপমানরোধের আইনি বিধি নিশ্চিত করতে হবে।
২৭. প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি করছেন অনেকেই। বাংলাদেশে একে যথোচিত মনে করি না। বরং সংবিধানের ৫৯ ও ৬০-এ স্থানীয় শাসনের বদলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা যেতে পারে, যা কার্যকর অর্থে জনগণের সরকার হবে।
২৮. ইসলামী ব্যাংক, জাকাত ও বীমাসংক্রান্ত বিষয়ে আলাদা আইন প্রণয়ন জরুরি।
হয়তো আরো বহু দিক ও প্রসঙ্গ হাজির করা সম্ভব। কারণ প্রচলিত সংবিধান তার মৌলিক প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। এই না পারার মূলে আছে তারই মধ্যে নিহিত গণস্বার্থ বৈরী নানা স্ববিরোধ ও ফাঁকফোকর। এগুলো একটি অসুস্থ ও অগ্রহণীয় সিস্টেম তৈরি করেছে রাষ্ট্রের সর্বত্র। যা থেকে আমাদের মুক্তি না ঘটলে কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম হবে না।