আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশ বুরকিনা ফাসোর অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে সম্প্রতি সৌদি আরবের ২০০টি মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর মতে, দেশের জনগণের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামো উন্নয়নই বেশি জরুরি। ত্রাওরের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কেউ এটিকে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ এটিকে রাজনৈতিক জনতুষ্টির কৌশল হিসেবে বিবেচনা করছেন।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে তৎকালীন শাসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল হেনরি দামিবাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩৭ বছর বয়সী এই সামরিক কর্মকর্তা শুরু থেকেই সাহসী এবং আত্মনির্ভরশীল নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
ক্ষমতা নেওয়ার পর, তিনি বুরকিনা ফাসোকে আঞ্চলিক জোট ইকোওয়াস (ECOWAS) থেকে বের করে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং নাইজার ও মালির সঙ্গে মিলে "অ্যালায়েন্স অব সাহেল স্টেটস" নামে নতুন একটি জোট গঠন করেন। তাঁর নীতিগত অবস্থান এবং সিদ্ধান্তগুলোর কারণে আন্তর্জাতিক মহলে তিনি এক নতুন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, সৌদি আরব বুরকিনা ফাসোতে ২০০টি মসজিদ নির্মাণের জন্য বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে প্রেসিডেন্ট ত্রাওরে এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে সৌদি সরকারকে অনুরোধ করেছেন, যেন তারা দেশটির শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করে।
তাঁর মতে, দেশে ইতোমধ্যে পর্যাপ্ত মসজিদ রয়েছে এবং অনেক মসজিদ ব্যবহারের অভাবে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বরং দেশের উন্নয়নের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করাই বেশি জরুরি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ত্রাওরের এই সিদ্ধান্ত শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং এটি রাজনৈতিক ও কৌশলগত পদক্ষেপ। আফ্রিকার অনেক দেশে ধর্মীয় স্থাপনার তুলনায় মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতা দেখা যায়। তাই জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য ত্রাওরে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ত্রাওরে বুরকিনা ফাসোর সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক সংস্কার চালাচ্ছেন। তিনি সরকারি প্রকল্পগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনিক পরিবর্তন এনেছেন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে নজর দিয়েছেন।
বিশেষ করে, ২০২৪ সালের ১২ জুলাই তিনি ১,০০০টি সামাজিক আবাসন ইউনিট নির্মাণের ঘোষণা দেন, যা ২০৩০ সালের মধ্যে সব নাগরিকের জন্য পর্যাপ্ত বাসস্থান নিশ্চিত করার একটি পরিকল্পনার অংশ। এছাড়াও, তাঁর সরকার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) থেকে সহায়তা গ্রহণের পরিবর্তে দেশের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছে।
বুরকিনা ফাসো দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর হামলার শিকার। প্রেসিডেন্ট ত্রাওরে ক্ষমতা গ্রহণের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে তাঁর শাসনামলে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা কমেনি, বরং কিছু পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে।
ত্রাওরে সরকার সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক মিলিশিয়াদের একত্রিত করে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও এ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে যে, কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষও সরকারি বাহিনীর হামলার শিকার হচ্ছেন।
ত্রাওরের নেতৃত্বকে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তিনি ফ্রান্সের সামরিক প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁর প্রশাসনের বিরুদ্ধে বাক-স্বাধীনতা খর্ব করা, বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করা এবং মিডিয়ার কণ্ঠ রোধ করার অভিযোগও রয়েছে।
বুরকিনা ফাসোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। ত্রাওরের নেওয়া পদক্ষেপগুলো যদি সফল হয়, তবে তিনি দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবেন। অন্যথায়, সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।