পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে স্বাস্থ্য বিভাগের কোন দায় নেই বরং র্যাগিং বা অন্য কোন ঘটনা ধামাচাপা দিতে স্বাস্থ্য বিভাগের উপর দোষ চাপিয়ে পোষ্টমর্টেম না করেই লাশ নিয়ে দাফন করার পাল্টা অভিযোগ করেছেন পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
বুধবার (১৬ এপ্রিল) বিকেল ৪টায় হাসপাতালের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ করেন ইন্টার্ন ও সিনিয়র চিকিৎসকরা।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. শাহরিয়ার আনজুম শুভ, ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. সাদিয়া রহমান রিমি, ডা. অনন্যা, আক্তার ইলমি সহ অন্যান্যদের অভিযোগ, পবিপ্রবির কৃষি অনুষদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হুসাইন মোহাম্মদ আশিককে গুরুতর অবস্থায় সোমবার বিকেল চারটা দশ মিনিটের সময় সময় পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসা হয়। তাকে ভর্তির পর প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ৪টা ১২ মিনিটে মেডিসিন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। ৪ টা ১৫ মিনিটের সময় রোগী মেডিসিন ওয়ার্ডে পৌঁছালে তখনই তাকে বেডে নিয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা অক্সিজেন দিয়ে তার চিকিৎসা চালু করেন। এ সময় ওই শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা তাদের চিকিৎসা দিতে অসহযোগিতা করে রোগীর শরীরে তেল মালিশ এবং বারবার অক্সিজেন মাস্ক খুলে রোগীর মুখ থেকে রক্ত পরিষ্কার করতে থাকেন। এ কাজে তাদের বারণ করলে উল্টো তারা রোগীর কিছু হলে দেখে নেবেন বলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হুমকি দেন এবং বড় ডাক্তারকে আসতে বলেন। ৪টা ২২ মিনিটের সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা অনকলে থাকা জুনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি) ডাঃ এ এম এস শামীম আল আজাদকে ফোন করেন ও রোগীর অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলে তিনি তাদেরকে রোগীর চিকিৎসা সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দেন। ৪টা ৩৭ মিনিটে ওয়ার্ডে এসে রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন ও চিকিৎসা দেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
তারা আরো বলেন, পানিতে ডোবা রোগীদের মুখ দিয়ে ফেনা বের হলেও রক্ত আসতে দেখা যায় না। এই রোগীর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছিল। যেটি অন্য কোন আঘাতের ইঙ্গিত বহন করে। এছাড়া রোগীর পোস্টমর্টেম করতে দিতে তারা কোনক্রমেই রাজি হচ্ছিল না। এতে অন্য কোন কিছু ঘটেছে বলে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। এদিকে তদন্ত কমিটিতেও সিভিল সার্জন ছাড়া অন্য কোন চিকিৎসককে না রেখে একাধিক ছাত্রকে রাখা হয়েছে। তবে সুষ্ঠু তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে এবং দোষীদের সনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে, এমন দাবি তাদের।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি) ডাঃ এ এম এস শামীম আল আজাদ বলেন, আমি ডরমেটরিতে রেস্টে ছিলাম, ৪ টা ২২ মিনিটের সময় ইন্টার্ন ডাক্তারদের ফোন পেয়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে চিকিৎসা চালু করতে বলি। এরমধ্যে এই রোগীর জন্য ডাক্তার ওয়াহিদ শামীম ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ দিলরুবা ইয়াসমিন লিজার ফোন পাই তাদেরকে আশ্বস্ত করে আমি তৈরি হয়ে ৪ টা ৩৭ মিনিটে ওয়ার্ডে পৌঁছাই এবং রোগীকে পর্যবেক্ষণ করি। রোগীর পালস পাওয়া যাচ্ছিল না রোগীর শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে আমি রোগীকে সিপিআর করি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। তারা দায়িত্বে অবহেলার যেসব অভিযোগ করেছে সেটি নেহায়েতই দায়সারা গোছের। রোগীর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল যা পানিতে ডোবা রোগীদের হয় না। এটি অভ্যন্তরীণ কোন আঘাতের ফল এবং সেটি র্যাগিংয়ের কারণে হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, আমরা মনে করি এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। শিক্ষার্থী কোনোভাবে সহিংস আচরণের শিকার হয়ে থাকতে পারেন। তাই ময়নাতদন্তের আবেদন জানাচ্ছি, যাতে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটন সম্ভব হবে।
এদিকে শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকের অবহেলার অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষনিক ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট প্রদানের আগেই দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কার্ডিওলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডাঃ এএসএম শামীম আল আজাদকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে, মহাখালী, ঢাকায় অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। ১৬ এপ্রিল (বুধবার) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ডা. শামীম আল আজাদকে ওএসডি করার ঘোষণা দেয়।
উল্লেখ্য, গত ১৪ এপ্রিল দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে পুকুরের পানিতে ডুবে যায় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হুসাইন মোহাম্মদ আশিক। তাকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে সহপাঠীরা বিশ্ববিদ্যালয় হেলথ সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে দুমকি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন চিকিৎসকরা। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়। তার আকস্মিক মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আনেন চিকিৎসক ও নার্সদের বিরুদ্ধে। ঘটনার পরপরই শিক্ষার্থীরা মেডিকেল কলেজ ঘেরাও করে বিক্ষোভ শুরু করেন। স্বাস্থ্যসেবার নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তোলেন। পরে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। রাতে আশিকের লাশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এনে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মরদেহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত ১৫ এপ্রিল (মঙ্গলবার) বিকেলে শিক্ষার্থীরা প্রথমে ঢাকা-বাউফল সড়ক অবরোধ করেন। পরে ঢাকা কুয়াকাটা মহাসড়কের পায়রা সেতুর টোল প্লাজার সামনে অবস্থান নিয়ে মানববন্ধন করেন এসময় মহাসড়কের দুই দিকে দীর্ঘ যানযটের সৃষ্টি হয়। এই কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা দায়িত্বরত চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের অবহেলার তীব্র নিন্দা জানান এবং দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেন উপাচার্য প্রফেসর ড. কাজী রফিকুল ইসলামসহ আন্যান্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাগন।
এদিকে, একজন সিনিয়র ডাক্তার ওএসডি করার প্রতিবাদে আজ থেকে সকল ইন্টার্নি চিকিৎসকরা সাময়িক সময়ের জন্য আউটডোর সেবা বন্ধ এবং ডাক্তার নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে আজ ১৭ এপ্রিল থেকে অবস্থান ধর্মঘট ও মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন। এ কর্মসুচী পালন কালীন সময়ে রোগীদের সাময়িক সাময়িক অসুবিধার জন্য দু:খ প্রকাশ করেছেন ডাক্তাররা।