অর্থপাচার: অর্থনীতির নিঃশব্দ ক্ষরণ

এফএনএস | প্রকাশ: ৩১ জুলাই, ২০২৫, ০৭:০৫ পিএম
অর্থপাচার: অর্থনীতির নিঃশব্দ ক্ষরণ

দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তোলার পেছনে একটি অদৃশ্য ও মারাত্মক শক্তি কাজ করছে-তা হলো অর্থপাচার। এই অপরাধের প্রকৃতি যতটা জটিল, এর পরিণতি ততটাই মারাত্মক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর সাম্প্রতিক এক গোলটেবিল আলোচনায় যে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপিত হয়েছে, তা উদ্বেগজনক ও রাষ্ট্রীয় আর্থিক নিরাপত্তার প্রতি বড় হুমকি নির্দেশ করে। গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই অর্থপাচারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৩.৪ শতাংশ। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো-এই বিপুল পরিমাণ অর্থের ৭৫ শতাংশই পাচার হচ্ছে বাণিজ্যের মাধ্যমে, অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে এমন কৌশলী ও সুপরিকল্পিত পাচারমূলক কার্যক্রম এখন আইনের আওতার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। প্রথাগত নজরদারির ফাঁক গলে পাচারকারীরা দেশের টাকা নিয়ে যাচ্ছে বিদেশে-মূলধন চলে যাচ্ছে, বিনিয়োগ হারাচ্ছে গতি, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পড়ছে চাপে। অর্থপাচারের এ প্রক্রিয়া যত জটিল, তা রোধে ততটাই দুর্বল আমাদের তদারকি কাঠামো। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশে ব্যাংকগুলো লেনদেন যাচাই, নিষেধাজ্ঞা তালিকা ও মূল্য যাচাই প্রক্রিয়ায় কিছুটা সক্ষমতা অর্জন করলেও এখনো অনেক ক্ষেত্রে তা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহারের বক্তব্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেন, নিয়ম মেনে চললেই পাচারকারীদের ধরা যাবে না; তাঁদের ধরতে চাই বুদ্ধি ও সতর্কতা। এটিই বাস্তবতা। কারণ আজকের অর্থপাচার হচ্ছে এমন এক উপায়ে, যা দেখতে বৈধ বাণিজ্য মনে হয়, অথচ ভেতরে লুকিয়ে থাকে জালিয়াতির ছক। এমনকি অনেক সময় এই মিথ্যা ঘোষণার বাণিজ্য থাকে আন্তর্জাতিক পর্দার আড়ালে, যাকে চিহ্নিত করতে কেবল দেশীয় সংস্থার সক্ষমতাই যথেষ্ট নয়। এই অর্থপাচার শুধু দেশের সম্পদ হারানো নয়-এটি রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসের ওপর আঘাত। একজন সাধারণ করদাতা যখন দেখে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হচ্ছে, অথচ সেই অর্থনৈতিক চাপের বোঝা তাকেও বইতে হচ্ছে-তখন তার নাগরিক মনোবল ভেঙে পড়ে। আবার এসব পাচার করা অর্থ বিদেশে ব্যবহৃত হয় বিলাসিতা, অবৈধ সম্পদ অর্জন কিংবা দুর্নীতিকে বৈধতায় রূপ দেওয়ার কাজে-যা সমাজে একটি গভীর বৈষম্য ও হতাশার জন্ম দেয়। আমরা মনে করি, অর্থপাচার ঠেকাতে শুধু আইনি কাঠামো নয়, চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাহসী প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখন প্রশ্ন করতে হবে-যাঁরা নিয়ম লঙ্ঘন করে পাচার করছেন, তাঁদের সহযোগিতা কোথা থেকে আসছে? কাদের ছত্রছায়ায় তারা এত বড় বড় লেনদেন নির্বিঘ্নে করে চলেছে? এই নীরব ক্ষরণকে থামাতে না পারলে, দেশের অর্থনীতি শুধু টালমাটাল নয়-ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। এখনই সময়, শক্ত হাতে ধরার, কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর।