প্রযুক্তির বিকাশ, অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ-এই তিন শক্তির সম্মিলিত প্রভাবে রাজধানী ঢাকা আজ যে ভয়াবহ পরিবেশগত সংকটে পড়েছে, তা আর উপেক্ষার অবকাশ রাখে না। গত ৪৪ বছরে ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বেড়েছে সাত গুণ, অথচ এই সময়ে হারিয়ে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ জলাধার, অর্ধেকের বেশি সবুজ আচ্ছাদন। একইসঙ্গে ভূমির তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এসব তথ্য নতুন করে উঠে এসেছে গবেষণা সংস্থা 'চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ'-এর 'প্রকৃতিবিহীন ঢাকা?' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে। ঢাকার আদাবর, কাফরুল, রামপুরা, ওয়ারী, বংশালের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে গাছ নেই বললেই চলে। মিরপুর, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, দারুসসালাম এলাকায় জলাশয় প্রায় নিঃশেষ। ৫০টি থানার মধ্যে ৩৭টিই নিরাপদ নির্মাণসীমা অতিক্রম করেছে। রাজধানীর প্রধান প্রধান এলাকা আজ 'হটস্পট'-উষ্ণতা ও দুষণের কবলে। এটা শুধু একটি নগরের সংকট নয়, এটি একটি মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন, একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ হুমকিতে ফেলার নামান্তর। গবেষণাটি সতর্ক করে দিয়েছে-এভাবে চললে ঢাকার জলবায়ু সহনশীলতা একসময় পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন নগর পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন, যেখানে মানুষের চেয়ে প্রকৃতির অধিকারকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। গবেষণায় বলা হয়েছে, শহরের প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যূনতম ৯ বর্গমিটার গাছপালা ও ৪.৫ বর্গমিটার জলাধার সংরক্ষণ করতে পারলে ঢাকার গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো সম্ভব। তথ্যভিত্তিক এই গবেষণা আমাদের নগর উন্নয়নের নীতি ও বাস্তবতার মধ্যে বিরাট বৈপরীত্যের কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে। যে শহরে কোনো ন্যায্য পরিবেশগত ভারসাম্য নেই, যেখানে ভবন আগে গজায়, পরে আসে রাস্তা, ড্রেনেজ কিংবা খেলার মাঠ-সেই শহর টিকে থাকতে পারে না, আর তার বাসিন্দারা সুস্থ জীবন প্রত্যাশাও করতে পারেন না। এখন প্রশ্ন-আমরা কি ঢাকাকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে দেখতে প্রস্তুত? আমরা কি আইন ও নীতিনির্ধারণে প্রকৃতির অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত? শুধু উন্নয়নই নয়, পরিবেশগত সুবিচারও এখন সময়ের দাবি। ঢাকাকে নিয়ে ভাবার সময় ফুরিয়ে এসেছে। এবার প্রয়োজন বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত, কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নাগরিক সচেতনতা। নগর নয়, এবার প্রকৃতিই হোক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু-তবেই রক্ষা পাবে রাজধানী, বাঁচবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।