পতিত সরকারের আমলে ব্যাপক লুটপাটের কারণে দেশের ব্যাংক খাত খাদের কিনারে গিয়ে পৌঁছেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী আমলের লুটপাটের ঘটনা তদন্ত শুরু করলে ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে বেপরোয়া লুটপাটে সৃষ্ট ক্ষত কৌশলে আড়াল করে রাখা হতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে এ ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা ছিল। এতে বেড়েছে তারল্য ও ডলার সংকট; মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ঊর্ধ্বমুখী। জানা যায়, ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে লোপাটকারীরা। এর বড় অংশই পাচার করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক সাত লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের লুটপাটের কারণে সৃষ্ট সংকটে বর্তমান সরকারের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। এদিকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শুধু শীর্ষ একশ ঋণখেলাপির কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ১৩২ কোটি টাকায়, যা মোট খেলাপি ঋণের ২৬ শতাংশ। গত এক বছরে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ছিল প্রকট। ছোট-বড় অনেক ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা নিয়মিত টাকা তুলতে পারেননি, যা এখনো অব্যাহত। সব মিলিয়ে আলোচ্য সময়ে টাকার জন্য একরকম হাহাকার পড়েছিল ব্যাংক খাতে। বর্তমান সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপে বন্ধ হয়েছে ব্যাংক খাতে নতুন লুটপাট। ব্যাংকগুলোকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রবণতাও বাতিল করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। দেশ-বিদেশে কয়েকজন অর্থ পাচারকারীর সম্পদ জব্দ করায় আশা করা যায়, অন্য ঋণখেলাপিরা সতর্ক হবেন। ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা দূর করতে ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, এসবের সুফল পেতে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। লুটপাট ও অর্থ পাচার বন্ধ হওয়ায় ইতোমধ্যে ব্যাংক খাতে তারল্যের জোগান বাড়তে শুরু করেছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আইএমএফের মতে, ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধার করতে কমপক্ষে ৪ লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে একীভূতকরণের তালিকায় থাকা ৫টি ব্যাংককে সচল করতে আগামী এক বছরের মধ্যে ২ লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন। বস্তুত দেশের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত; কী করণীয় তা-ও বহুল আলোচিত। বিগত বছরগুলোতে এ খাতের নানা সংকট নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও কেন সুফল মেলেনি, তা খতিয়ে দেখে সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপি ঋণ সমস্যা ব্যাংক খাতের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সরকারের আমলে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ না কমে কেন অব্যাহতভাবে বেড়েছিল, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে। যেহেতু খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে দুরারোগ্য ব্যাধির রূপ নিয়েছে, সেহেতু এ খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। ব্যাংক খাতের সব সংকট দূর করার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কাজেই বর্তমান সরকারের আমলে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে, পরবর্তী সরকারের আমলেও সেগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।