চলাচলের রাস্তা এবং মাস্টার প্ল্যান থাকা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতের রিট পিটিশনের জবাব না দেয়ায় তিন বছর যাবত স্থবির হয়ে রয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) কাউনিয়া হাউজিং টু এর প্রকল্প। অভিযোগ রয়েছে, বিসিসির গাফলতির কারণে সাংবাদিক, আইনজীবী, মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা পেশার ভূমিহীনরা সিটি করপোরেশনে প্লটের টাকা জমা দিয়েও তা বুঝে পাননি।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন, তিন বছর পার হলেও প্লট না পেয়ে ছয় ব্যাক্তির দায়ের করা এক মামলা মোকাবেলার উদ্যোগ গ্রহন করেনি বিসিসি কর্তৃপক্ষ। ফলে টাকা দেয়া সত্ত্বেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেনা ভূক্তভোগিরা। মাস্টার প্লান/নকশা এবং চলাচলের রাস্তা নেই দাবি করে উচ্চ আদালতে দায়ের করা ওই রিট পিটিশনের জবাব দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
তাদের দাবি, প্রকল্পের চার ভাগের তিন ভাগ প্লট এখনো চিহ্নিত করে গ্রাহকদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। তার আগেই চলাচলের রাস্তা নেই দাবি করে মামলার বিষয়টি অযৌক্তিক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সাংবাদিক জানান, তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে ঘর ভাড়া করে বসবাস করে আসছেন।
লটারির মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের একটি প্লট পেলেও কাউনিয়া এলাকার এক ভূমিদস্যু ভুয়া তথ্য দিয়ে হাইকোর্টে রিটের বরাত দিয়ে নানা অপপ্রচার চালিয়েছেন।
এমনকি সাবেক মেয়র ও শেখ মুজিবুর রহমানের আপন ভাগ্নে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের প্রভাব খাটিয়ে মামলার বাদীরা সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের রিটের জবাব দিতে দেয়নি। ওই সাংবাদিক আরো জানান, তিনিসহ অনেকেই ঋণ নিয়ে প্লটের প্রথম কিস্তির তিন লাখ টাকা করে জমা দিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, মামলার বাদী মকবুল গাজী ওই এলাকার কমিশনার রফিকুল ইসলাম খোকন ওরফে মামা খোকনের প্রধান সহযোগি।
সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের সময়ে এই প্রকল্প মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন আনা হয়েছিল। পাশেই কাউনিয়া হাউজিং প্রকল্প এক চলমান।তৎকালীন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এবং তার চাচা খোকন আব্দুল্লাহর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকার প্রভাব পরেছে তাদের ওপর। বরিশাল বেতারের শিল্পী মুজিব মেহেদী জানান, ৪/৫ বছর আগে বরিশাল সিটি করপোরেশন কাউনিয়া হাউজিং প্রকল্প দুইয়ের প্লট বিক্রি করার বিজ্ঞপ্তি দেয়। তখন তিনি ফরম ক্রয় করে সিটি করপোরেশনে জমা দেন। পরে শুনতে পান লটারিতে তিনি একটি প্লট পেয়েছেন। তার মতো আরো ২৪০ জন প্লট পায়। তাদের থেকে এককালীন ২৫ পার্সেন্ট আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বরিশাল সিটি করপোরেশনের কোষাগারে জমা নেয়। প্লটগুলোকে এ.বি.সি.ডি চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করে মূল্য নির্ধারণ করে। যেগুলোর দাম পরে ১০ থেকে সাড়ে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এগুলো বালু ফেলে ভরাট করে দেয়ার কথা থাকলেও তা করেনি বিসিসি।
অনেক গ্রাহক লাখ লাখ টাকা খরচ করে বালু ফেলে ভরাট করে বাউন্ডারি দেয়াল দিয়েছে। পরবর্তীতে প্লট না পাওয়া কাউনিয়া এলাকায় মকবুল গাজীসহ ছয় ব্যাক্তি মাস্টার প্লান বা নকশা এবং চলাচলের রাস্তা নেই দাবি করে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন ১৮৯০/২০২২ দায়ের করেন।
প্রথমে তিন মাস, পরে ছয় মাস এবং সবশেষ ১২ মাসের স্টাটাস্কো দেয় উচ্চ আদালত। পরে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বিসিসি কাউনিয়া হাউজিং প্রকল্প ২ এর সমস্ত কাজ স্থগিত রাখে।
ফলে প্লট গৃহীতাদের নির্মাণাধীন কাজ থেমে যায়। রাস্তা, ড্রেন, কালভার্ট, প্লে গ্রাউন্ডসহ সবকিছু শুরুর আগেই স্থগিত করে বিসিসি। এতে করে বিপাকে পরে ২৪০ জন প্লট গৃহিতা।
এ ক্যাটাগরির এক প্লট গ্রহীতা জানান, কোন ভুল করলে বিসিসি করেছে। তারা কেন খেসারত দেবে। মামলার মূল বাদী মকবুল গাজীর ওই এলাকায় অনেক জমি আছে। তিনি পাঁচতলা ভবনের মালিক। আপন এক প্রতিবন্ধী ভাই এবং আরেক মৃত ভাইর সম্পদ দখলে রেখেছেন তিনি। তাদের কয়েকজনের জন্য আজ আড়াইশ' পরিবার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
তানভীর নামের এক প্লট গ্রহীতা জানান, পেপারে বিজ্ঞপ্তি দেখে সি ক্যাটাগরির ২.৫০ শতকের একটি প্লট কেনার উদ্দেশ্যে বরিশাল সিটি করপোরেশনের কাউনিয়া হাউজিং প্রকল্পের ফরম ক্রয় করেন।
২০২২ সালের লটারি হওয়ার পর ফলাফল দেখে তিনি জানতে পারেন তিনি একটি প্লট পেয়েছেন। পরে সিটি করপোরেশনের রাজস্বখাতে তিনি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন। ভূমিহীন এই ব্যক্তি সিটি করপোরেশনের নির্দেশে তার প্লটে বালুও ফেলেছেন। হঠাৎ মামলার দোহাই দিয়ে সিটি করপোরেশন তাদের কাজ বন্ধ রাখতে বলেন।
বাউন্ডারি দেয়াল, বালু ফেলা এবং সিটি করপোরেশনকে এককালীন দেয়া বাবদ প্রায় আট লাখ টাকা তিনি খরচ করেছেন। কিন্তু এরপর তিন বছর পার হলেও মামলার ওই জটিলতা নিরসন করেনি সিটি করপেরেশন।
তিনি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে মামলা নিরসনের দাবি করেছেন সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে। মামলার বাদী মকবুল গাজীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারি জানান, বাদি পক্ষ তার কাছে এসে রাস্তা ড্রেন নির্মাণের কথা বলেছেন। একটি হাউজিং প্রকল্প কখনোই চলাচলের রাস্তা, ড্রেন বাদ দিয়ে করার সুযোগ নেই। বাস্তবে নকশার থেকে বেশী রাস্তা রাখা হয়েছে। কিন্তু মনে হয় প্লট না পেয়ে একটি পক্ষ উচ্চ আদালতে এই অভিযোগটি করেছেন।
তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন মামলার বিষয়টি আমলে নিয়েছে। ইতোমধ্যে আইনজীবী নিয়োগ করে মামলার জবাব দেয়ার চেষ্টা চলমান রয়েছে।বিসিসির আইনজীবী এনায়েত হোসেন বাচ্চু বলেন, মামলার জবাবের প্রস্তুতি চলমান রয়েছে। মামলার স্বার্থে এই মুহুর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না।