বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো তিনটি অঞ্চলকে আনুষ্ঠানিকভাবে পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হলো। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার মোট ২৫টি উপজেলার ৪৭টি ইউনিয়নকে অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী, তবে একই সঙ্গে উদ্বেগজনকও। কারণ এটি প্রমাণ করছে-দেশে পানি সংকট আর আশঙ্কা নয়, বরং বাস্তবতা। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বহুদিন ধরেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজে নির্বিচারে নলকূপ ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধারা এ অঞ্চলের পানিসম্পদকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ইতিমধ্যেই কৃষি, বিশেষ করে বোরো ধানের আবাদ সরাসরি সংকটে পড়ছে। খাবার পানি ও দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোও কঠিন হয়ে উঠেছে। পানি আইন, ২০১৩-এর আলোকে এ এলাকাকে সংকটাপন্ন ঘোষণা মানে এখানকার পানির ব্যবহার এখন থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে। তবে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিকল্প সরবরাহ ও পানি ব্যবস্থাপনার টেকসই পরিকল্পনা না নিলে এ উদ্যোগ কার্যকর হবে না। শুধু উত্তরাঞ্চল নয়, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কিছু ইউনিয়ন ও পৌরসভাকেও অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, পানি সংকট এখন আঞ্চলিক সমস্যা নয়, জাতীয় সংকট। একই সভায় নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্তও এ আশঙ্কাকে আরও স্পষ্ট করে। এ প্রেক্ষাপটে দুটি হাওর-টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওরের জন্য প্রথমবারের মতো ‘হাওর প্রতিবেশ সুরক্ষা আদেশ’ জারি করার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, কৃষি ও মৎস্য খাতের টেকসই উন্নয়ন এবং পর্যটন নিয়ন্ত্রণ এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি এখন সময়ের দাবি। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়-পানি আইন, ২০১৩ কার্যকর হয়নি কেন? যদি কার্যকর হতো, তাহলে এত দেরিতে সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করতে হতো না। সভায় আইনটির সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু সংশোধন কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো ফল আসবে না। বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা এবং কঠোর নজরদারি অপরিহার্য। শিল্পখাতে পানি ব্যবহারের জন্য প্রণীত ‘পানি ব্যবস্থাপনা নীতি ২০২৫’-এর খসড়া এই মুহূর্তে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। কারণ শিল্পই বর্তমানে পানির বড় ভোক্তা এবং দূষণের প্রধান উৎস। কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালি খাতে পানির ব্যবহারকে সুষ্ঠুভাবে ভারসাম্যে আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পানি সংকটের এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কেবল সতর্ক সংকেত নয়, এটি আমাদের জন্য এক ধরনের জাতীয় সতর্কবার্তা। এ সংকট যদি কার্যকর ব্যবস্থাপনা, টেকসই নীতি ও কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে মোকাবিলা না করা যায়, তবে কৃষি, শিল্প, এমনকি দৈনন্দিন জীবনও ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এখনই দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেওয়া দরকার-কেবল সভা-সমিতির সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠপর্যায়ে পরিবর্তন ঘটাতে হবে।