সাম্প্রতিক এমআইসিএস ২০২৫ জরিপের প্রাথমিক ফলাফল আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগের বার্তা দিয়েছে। শিশুমৃত্যু হ্রাস, বাল্যবিবাহ কমানো বা শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির মতো সাফল্য থাকলেও নতুন তথ্যবলয় আমাদের সামনে এক অনিবার্য সত্য তুলে ধরে-অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিও বাড়ছে, এবং এই ঝুঁকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন করছে। জরিপ বলছে, দেশে শিশুশ্রমে নতুন করে আরও ১২ লাখ শিশু যুক্ত হয়েছে। এটি শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর জন্য একটি গভীর বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। যে বয়সে শিশুদের শেখার, খেলার ও বেড়ে ওঠার কথা, সেই বয়সেই তাদের শ্রমে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে জীবিকা বা পারিবারিক দারিদ্র্যের চাপে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরেকটি ভয়ংকর হুমকি-সীসা দূষণ। মাত্র ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে চারজনে একজনের রক্তে নিরাপদ মাত্রার ওপরে সীসা পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় এই হার ৬৫ শতাংশ, যা বিশ্বমানদণ্ডে এক মহাসতর্কবার্তা। সচ্ছল পরিবারের শিশুরাও এ দূষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না, যা প্রমাণ করে সীসা-দূষণ কেবল দরিদ্রতার সমস্যা নয়; এটি একটি সার্বজনীন অবহেলার ফল। সীসা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে স্থায়ী ক্ষতি করে, শেখার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দূষণের উৎস-পেইন্ট, ব্যাটারি পুনর্ব্যবহার, মাটির হাঁড়িপাতিল, পানির পাইপ বা শিল্পবর্জ্য-সবক্ষেত্রেই কঠোর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। পুষ্টি সূচকে ফিরে আসা অবনতির ইঙ্গিতও উদ্বেগজনক। মায়েদের অ্যানিমিয়া, কম ওজনের শিশু বৃদ্ধি এবং কিশোরী জন্মহারের উর্ধ্বগতি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাকে আবারও সামনে নিয়ে আসে। জন্মনিবন্ধনের ঘাটতি, সহিংসতার উচ্চ হার এবং নিরাপদ পানি ব্যবহারে পতন শিশুদের সামগ্রিক সুরক্ষায় নতুন প্রশ্ন তোলে। জরিপে আরও উঠে এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য-ভর্তি যত সহজ, ঝরে পড়া তত দ্রুত। মৌলিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থতা ভবিষ্যৎ কর্মবাজারে প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেবে। এই সব সংকেত কেবল পরিসংখ্যান নয়; এগুলো প্রতিটি শিশুর অধিকার, সম্ভাবনা ও নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই এখনই সমন্বিত নীতি, লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ ও বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা অপরিহার্য। শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর প্রয়োগ, সীসা-দূষণের উৎস নির্মূল, মাতৃ-শিশু পুষ্টিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশযোগ্যতা বাড়ানো এবং নিরাপদ পানি-স্যানিটেশন নিশ্চিত করা হবে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ। আমাদের অগ্রগতি তখনই অর্থবহ হবে, যখন দেশের প্রতিটি শিশু নিরাপদ পরিবেশে বাঁচতে, শিখতে ও বেড়ে উঠতে পারবে। শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষাই আজকের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রিক ও সামাজিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।