চলনবিলে বাউৎ উৎসবে মেতে উঠেছেন সৌখিন মাছ শিকারীরা

এফএনএস (হেলালুর রহমান জুয়েল; চাটমোহর, পাবনা) : | প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর, ২০২৫, ০৬:৫৬ পিএম
চলনবিলে বাউৎ উৎসবে মেতে উঠেছেন সৌখিন মাছ শিকারীরা

নাটোর,সিরাজগঞ্জ,বগুড়া,কুষ্টিয়া,টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সৌখিন মৎস্য শিকারিরা প্রতিবারের ন্যায় এবারেও মেতেছেন চলনবিলের বাউৎ উৎসবে। বিলের নানা প্রজাতির মাছ শিকার যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

সাপ্তাহিক মৎস্য শিকারী দিবস হিসাবে খ্যাত গত শনিবার (২৯ নভেম্বর) ভোররাত থেকেই হাজার হাজার সৌখিন মৎস্য শিকারী জড়ো হয় রুহুল বিল পাড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাকডাকা ভোর থেকে আসা বাউৎদের  কারো হাতে পলো,কারো হাতে খেয়া জাল,বাদাই জালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। এক এক গ্রাম-মহল্লা থেকে দল বেঁধে বিলে নেমে মনের আনন্দে মাছ শিকার শুরু করেন। দীর্ঘ জলাশয় অতিক্রম করে কেউ পান বোয়াল,কেউ বা শোল,গজার,রুই,কাতল। অনেকে ফিরছেন পুঁটি মাছ নিয়ে কিংবা খালি হাতে। এভাবেই চলনবিলে মাছ শিকারে মেতে ওঠেন সৌখিন মৎস্য শিকারিরা। চলনবিলের রুহুল বিল,বগাবিল,খলিশাগাড়ি বিল,ডিকশি বিল,বড় বিল,বিলকুড়ালিয়া,চিরইল বিল,রামের ভিরসহ অন্যান্য বিলে সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার বাউৎ নামে। এবারও সেই বাউৎ উৎসব শুরু হয়েছে। বিলে দল বেঁধে মাছ ধরার এই আয়োজনের নামই ‘বাউৎ উৎসব’। চলনবিলাঞ্চলে এমন উৎসব চলছে যুগের পর যুগ।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাউৎ উৎসবে অংশ নেন নানা বয়সী হাজারো মানুষ। তবে,এ বছর বিলে মিলছে না কাঙ্খিত মাছের দেখা। এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ মৎস্য শিকারিরা। তাদের অভিযোগ,অবৈধ চায়না দুয়ারি জাল আর গ্যাস ট্যাবলেট দিয়ে মাছ ধরে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। ফলে মাছ ও পোকামাকড় মরে গিয়ে পানিতে সৃষ্টি হয়েছে দুর্গন্ধ। গত শনিবার (২৯ নভেম্বর) সকালে গিয়ে দেখা যায় ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাটুলিপাড়া এলাকায় রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অন্তত ২০টি বাস। এসব বাসে কুষ্টিয়া,নাটোর,টাঙ্গাইল,সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন অনেক মৎস্য শিকারিরা। আবার অনেকে ইজিবাইক,অটোরিকশা,মোটরসাইকেল,ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে এসেছেন। এরপর রুহুল বিল অভিমুখে ছুটে চলে মানুষ। ভোরের আলো ফোটার আগেই বিলপাড়ে হাজির নানা বয়সী হাজারো মানুষ। সবার হাতে পলো,ঠেলা জাল,বাদাই জালসহ মাছ ধরার নানা উপকরণ। একসঙ্গে বিলে নেমে লোকজ রীতিতে মনের আনন্দে চলছে মাছ শিকার। দলবেঁধে মাছ ধরার এ আয়োজনে মৎস্য শিকারিদের ডাকা হয় বাউৎ। তাদের ঘিরেই উৎসবের নামকরণ। খোঁজ নিয়ে আরোও জানা গেছে,বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নভেম্বরের শেষে অথবা ডিসেম্বরের শুরুতে মাসব্যাপি চলে এই উৎসব। সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার ভোর থেকে বিলাঞ্চলের পূর্বনির্ধারিত এলাকায় দল বেঁধে মাছ শিকারে নামেন বাউৎ প্রেমিরা। চলনবিলের রুহুল বিল,ডিকশির বিল,রামের বিলসহ বিভিন্ন বিলে মাসব্যাপী চলে এই বাউত উৎসব। বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিল পাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। কে মাছ পেলেন,কে পেলেন না তা নিয়ে হতাশা নেই। তাদের কাছে আনন্দটাই বড় কথা।

সিরাজগঞ্জ থেকে মাছ শিকারে আসা নয়ন আলী বলেন,বাউত উৎসবের কথা অনেক শুনেছি। এবার সিরাজগঞ্জ থেকে ৬টি বাস নিয়ে দুই শতাধিক লোক এসেছি মাছ ধরতে। এত লোক একসঙ্গে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। খুব ভাল লেগেছে।

নাটোর থেকে বাউত উৎসবে আসা আরেক মৎস্য শিকারি আব্দুল মালেক বলেন,প্রতিবছরই আসি এই বাউত উৎসবে। কিন্তু এবার মাছ নেই বললেই চলে। তবে আমরা মাছ পাই বা না পাই, সবাই মিলে আনন্দ করি এটাই ভাল লাগে।

ফরিদপুর উপজেলার মাছ শিকারি আজাহার আলী বলেন,‘প্রভাবশালীরা আগেই চায়না দুয়ারী,কারেন্ট জাল দিয়ে সব মাছ মাইরে লিছে। পরে তারা বিলে গ্যাস ট্যাবলেট দিছে, যে কারণে ছোটখাটো মাছ যা আছে বেশিরভাগ মরে গেছে। পানিতেও দুর্গন্ধ ম্যালা। এজন্যি মাছ নাই ইবার।’ 

বিলে বাউত উৎসব দেখতে আসা আশিকুর রহমান,নয়ন ইসলাম,ফিরোজ হোসেন,জুয়েল আহমেদসহ কয়েকজন বলেন,‘বিলে যেভাবে গ্যাস ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়েছে তাতে দেশি মাছের প্রজনন নষ্ট হচ্ছে। জীববৈচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে অবৈধ চায়না দুয়ারী ও কারেন্ট জাল ব্যবহার হচ্ছে। এখনই প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। না হলে আগামীতে দেশি মাছের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির এই উৎসবও হারিয়ে যাবে।’

এ বিষয়ে চাটমোহরের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মতিন বলেন,বাউৎ উৎসব হচ্ছে এ অঞ্চলের এতিহ্য। তবে মাছের প্রজনন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি না করে বাউত উৎসব পালন করতে হবে। এ বিষয়ে মৎস্য শিকারিদের সচতেন হতে হবে। সেইসঙ্গে বিলে গ্যাস ট্যাবলেট বা অবৈধ জাল ব্যবহার বন্ধ করে মাছের ও পরিবেশের ক্ষতি করছে এমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে