থমকে আছে উত্তর সাতকানিয়ার উন্নয়ন

এফএনএস (মোহাম্মদ বেলাল হোছাইন; সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম) : | প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম
থমকে আছে উত্তর সাতকানিয়ার উন্নয়ন

দক্ষিণ চট্টগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হওয়া স্বত্বেও উত্তর সাতকানিয়ার উন্নয়ন থমকে আছে। চট্টগ্রাম - কক্সবাজার, চট্টগ্রাম - বান্দরবান এবং চট্টগ্রাম - বাঁশখালীর টার্নিং পয়েন্ট এবং অর্থনীতি ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রাণকেন্দ্র হওয়ার পরও এই অঞ্চলটি আবহমানকাল ধরে অবহেলিত। চলমান বঞ্চনার অবসানের জন্য সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাস ও স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন সচেতনমহল। এ লক্ষ্যে এক সময় গণ আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। দাবী আদায় না হওয়ায় তারা আবারো সক্রিয় হওয়ার চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, সাতকানিয়া উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা মিলে সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৬৪ হাজার ১৮৫ জন। ভোটাররা বিভিন্ন সময় কমবেশী ভোগান্তি পোহায়। তবে নিয়মিত বহুবিধ ভোগান্তির শিকার হয়ে থাকে ৬ ইউনিয়নের ১ লাখ ৭ হাজার ৯১৬ জন ভোটার।তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাতকানিয়া উপজেলার ভোটাররা দুই নির্বাচনী এলাকার সাথে যুক্ত। নির্বাচনী এলাকা : ২৯১ - চট্টগ্রাম -১৪ (চন্দনাইশ- সাতকানিয়া) আসনের সাথে যুক্ত আছে খাগরিয়া, কেওচিয়া, কালিয়াইশ, ধর্মপুর, বাজালিয়া এবং পুরানগড় ইউনিয়ন। এই ৬ ইউনিয়ন ছাড়া বাকি ১১ ইউনিয়ন এবং পৌরসভার ভোটারগণ নির্বাচনী এলাকা : ২৯২ - চট্টগ্রাম - ১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনের সাথে যুক্ত।মাঠ পর্যায়ে মতামত নিয়ে জানা যায়, ১১ ইউনিয়ন ও পৌরসভার ভোটারগণ চট্টগ্রাম-১৫ আসনে স্বস্থিবোধ করলেও চট্টগ্রাম-১৪ আসনের সাথে যুক্ত ৬ ইউনিয়নের অধিকাংশ ভোটার রয়েছেন চরম অস্বস্থিতে। উপজেলা ও থানা প্রশাসনের বিভিন্ন কাজ এবং সাংসদকেন্দ্রিক কর্মকান্ডে তারা চরম অস্বস্থিতে রয়েছেন বলে জানা যায়।সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম জানান, বর্তমানে চট্টগ্রাম-১৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত ৬ টি ইউনিয়নের মধ্যে খাগরিয়ায় ভোটার রয়েছে ২৫১৬১ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ১৩৫৮৯ জন এবং মহিলা ১১৫৭২ জন। কেওচিয়ায় রয়েছে ২২৭১৩ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ১২৪৫৫ জন এবং মহিলা ১০২৫৮ জন। কালিয়াইশে রয়েছে ১৭১৮৭ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৯১১২ জন এবং মহিলা ৮০৭৫ জন। ধর্মপুর ইউনিয়নে রয়েছে ১১৩৪২ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৬০০৩ জন এবং মহিলা ৫৩৩৯ জন। বাজালিয়া ইউনিয়নে রয়েছে ১৫৪৩৯ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৮১৯৬ জন এবং মহিলা ৭২৪২ জন।পুরানগড় ইউনিয়নে রয়েছে ১৬০৭৪ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৮২৩৪ জন এবং মহিলা ৭৮৪০ জন।চট্টগ্রাম-১৫ আসনভুক্ত চরতী ইউনিয়নে রয়েছে ২৭৪৫১ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ১৪৬৮০ জন এবং মহিলা ১২৭৭১ জন। নলুয়া ইউনিয়নে রয়েছে ১৬৮০৩ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৯১৬২ জন এবং মহিলা ৭৬৪১ জন কাঞ্চনা ইউনিয়নে রয়েছে ২০৫৭১ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ১০৯৪৩ জন এবং মহিলা ৯৬২৮ জন। আমিলাইষ ইউনিয়নে রয়েছে ১০৭৮৩ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৫৮৫৬ জন এবং মহিলা ৪৯২৭ জন। এওচিয়া ইউনিয়নে রয়েছে ২০৯১৬ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ১১৪৮০ জন এবং মহিলা ৯৪৩৬ জন। মাদার্শা ইউনিয়নে রয়েছে ১২৪৩৩ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৬৮১২ জন এবং মহিলা ৫৬২১ জন।ঢেমশা ইউনিয়নে রয়েছে ১৩৮৬১ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৭৫৭৪ জন এবং মহিলা ৬২৮৭ জন। পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নে রয়েছে ৭০৩৫ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৩৬৬২ জন এবং মহিলা ৩৩৭৩ জন। ছদাহা ইউনিয়নে রয়েছে ৩০৯৮৬জন। তন্মধ্যে পুরুষ১৬৯০৪ জন এবং মহিলা ১৪০৮২জন। সদর ইউনিয়নে রয়েছে ২৬৪৯২ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ১৪১১৫ জন এবং মহিলা ১২৩৭৭জন। সোনাকানিয়া ইউনিয়নে রয়েছে২৩৩৬১ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ১২৭৩৩জন এবং মহিলা ১০৬২৮জন। পৌরসভায় রয়েছে৪৫৫৭৭ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ২৩৭৭৪জন এবং মহিলা২১৮০৩ জন।তথ্যানুযায়ী, সাতকানিয়া উপজেলার মোট আয়তন প্রায় ২৮২.৪০ বর্গ কিলোমিটার। সীমিত লোকবল নিয়ে এত বড়ো জনপদ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে থানা প্রশাসন। লোকবল, যানবাহন ও সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে প্রায় ৭ লাখ জনগণ অধ্যুষিত সাতকানিয়ায় কাঙ্খিত সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে।সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মাহমুদুল হাসান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানমালা শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, "সাতকানিয়ায় যে হারে বরাদ্দ প্রয়োজন সে হারে মিলে না। প্রয়োজন ৭ লাখ। কিন্তু মিলে খুব কম।"সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুরুল হক বলেন, "সাতকানিয়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ থানা। এই এলাকার বাসিন্দা ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে অন্য এলাকার প্রচুর লোকজনও এখানে বাস করে। জনগণের জান-মালের নিরাপত্তায় পুলিশ সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে।"বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম বিশাল উপজেলা হওয়ায় সাতকানিয়াবাসী সরকারের বিভিন্ন সেবা হতে তুলনামূলক বঞ্চিত। সীমিত লোকবল নিয়ে আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয় থানা প্রশাসনকে। সবচেয়ে বেশী ভোগান্তির শিকার হয় চৌদ্দ আসনভুক্ত ইউনিয়নের বাসিন্দারা। তাদের ওসি এবং ইউএনও সাতকানিয়ার। কিন্তু এম.পি চন্দনাইশের। তাছাড়া অতীতে উক্ত আসনের এম.পি চন্দনাইশ উপজেলায় তুলনামূলক বেশী উন্নয়নমূলক কাজ করে সাতকানিয়ার ৬ ইউনিয়নকে অবহেলা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে ঘুরেও উক্ত অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া দুইজন এমপিকে প্রটৌকল দিতে গিয়ে সাতকানিয়া থানা ও উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় বেকায়দায় পড়ে। তাদের সুপারিশ আমলে নিতে গিয়েও বিভিন্ন সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার খবর মিলেছে। ভিন্ন আসনে যুক্ত থাকায় সাতকানিয়া উপজেলার ৬ ইউনিয়নের ভোটারগণ ভোগান্তি, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকেন বলে বিস্তর অভিযোগ আছে। এসবের অবসানের জন্য বিশাল সাতকানিয়া উপজেলার ১৭ টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন অথবা সাতকানিয়ার ৯ টি ইউনিয়ন নিয়ে আলাদা উপজেলা ও থানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন চিন্তাশীল মহল।একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও নারী সংগঠক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "সাতকানিয়া উপজেলা নিয়ে বাঁশখালীর মত স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন অথবা চট্টগ্রাম-১৪ আসনের সাথে যুক্ত ৬টি ইউনিয়নের সাথে ছদাহা, ঢেমশা এবং নলুয়া ইউনিয়নসহ মোট ৯ ইউনিয়ন নিয়ে কেরানিহাট কেন্দ্রিক আলাদা থানা ও উপজেলা গঠন করা গেলে এ অঞ্চলের উন্নয়ন ও আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। সাতকানিয়ার উভয় পাশের ২ উপজেলা চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া ৯ টি করে ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত।"এ বিষয়ে খাগরিয়ার বাসিন্দা, চট্টগ্রাম-১৪ আসনে মনোনয়ন সংগ্রহকারী বিএনপি নেতা শফিকুল ইসলাম রাহী (সিআইপি) বলেন, "চট্টগ্রাম-১৪ সংসদীয় আসনের সাতকানিয়া আংশিক এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছয়টি ইউনিয়ন তথা কেওচিয়া, কালিয়াইশ, বাজালিয়া, পুরানগড়, ধর্মপুর ও খাগরিয়াকে একটি প্রশাসনিক থানা হিসেবে গড়ে তোলা এবং পর্যায়ক্রমে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আমার পক্ষে সম্ভব সব ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে ইনশাআল্লাহ।"কেওচিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং কেরানিহাটের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, "উত্তর সাতকানিয়ার ৬ টি ইউনিয়ন সত্যিই অবহেলিত। এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।"কালিয়াইশের বাসিন্দা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান সাংবাদিক ফরিদ উদ্দিন বলেন, "উত্তর সাতকানিয়া আলাদা থানা এবং উপজেলা গঠিত হলেই বৈষম্যমুক্তভাবে উন্নয়ন সাধিত হবে।" একই ইউনিয়নের আরো একজন বাসিন্দা সাংবাদিক নজরুল ইসলামও একই মতামত ব্যক্ত করেছেন।বিভিন্ন কর্মকান্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-১৪ আসনভুক্ত ইউনিয়নের অধিকাংশ সচেতন জনগণ চট্টগ্রাম-১৫ আসনমুখী। কেওচিয়া ইউনিয়ন চৌদ্দ আসনভুক্ত। কিন্তু বিএনপির অধিকাংশ নেতা পনেরো আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাথে যুক্ত। চৌদ্দ আসনে তারা অনুপস্থিত। জামায়াতের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। অন্যান্য ইউনিয়নের চিত্রও একই।ছদাহা, ঢেমশা এবং নলুয়ার কয়েকজন সচেতন নাগরিক মত ব্যক্ত করে বলেন, উত্তর সাতকানিয়া নাম দিয়ে নতুন প্রশাসনিক থানা এবং উপজেলা গঠন করা জরুরী। কেরানিহাটের উত্তরে সুবিধাজনক স্থানে থানা ও উপজেলা কমপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে। তবে ছদাহা, ঢেমশা এবং নলুয়া ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সাথে অপর ৬ ইউনিয়ন মিলে মোট ৯ ইউনিয়ন নিয়ে নতুন থানা এবং উপজেলা গঠিত হবে। তাতে অন্তর্ভুক্ত হবে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৬৬ জন ভোটার। মূল সাতকানিয়ায় ৮ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভা মিলে ভোটার থাকবে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৬১৯ জন।এ বিষয়ে আরো জনমতামত এবং প্রশাসনের পরিকল্পনাসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হবে ইন শা আল্লাহ।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে