খেজুর গুড়ের ঐতিহ্যের কথা ভুলে অধিক লাভের আশায় ব্যাঙের ছাতার মতো শত শত কারখানা অপরিশোধিত চিনিগুড়ে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যহানিকর খেজুর গুড়। এই খেজুর গুড়ে নেই খেজুরের রস।এ গুড়ের উপাদান ঝোলা গুড় অপরিশোধিত ভারতীয় চিনি-গুড় রং, আটা, রাসায়নিক ও ভেষজ নির্যাস। যে কারণে প্রতি বছর খেজুর গাছের সংখ্যা কমলেও বাড়ছে গুড় উৎপাদন।কালীগঞ্জ শহরের নিমতলা বাসষ্টান্ডে প্রতি শুক্রবার ও শনিবার গুড়ের হাট বসে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়িরা এসে কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করে ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যায়। এ জেলার ৬টি উপজেলার আনাচকানাচে গড়ে উঠা কারখানার শত শত মণ খেজুরের গুড় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। এতে যেমন ঐতিহ্যবাহী খেজূর গুড়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৮০ শতাংশ খেজুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।কালীগঞ্জ ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে শহরের নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে শীত মৌসুমের সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার ও সোমবার এই হাট বসে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে এ এলাকায় খেজুরের রস বেশি হওয়ায় এলাকার কৃষকরা খেজুরের গুড় ও পাটালি উৎপাদন করে থাকে। হাটের দিনে প্রচুর খেজুরের গুড় ও পাটালি নিয়ে আসে বিভিন্ন গ্রাম থেকে। বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছে কালীগঞ্জ গুড়ের হাট নামে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। এই হাট কালীগঞ্জ নিমতলা এলাকার একটি ঐতিহ্য। কালীগঞ্জ,ঝিনাইদহ,কোটচাদপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত খেজুর গুড় ও পাটালি বিক্রির জন্য এখানে নিয়ে আসেন। বাজার ঘুরে চাষী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক হাড়ি/কলস (মাটির তৈরি) পত্রে ৮-১০ কেজি ওজনের গুড় বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা দরে। আর ঝোল (তরল) গুড় বিক্রি হচ্ছে এক কলস ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায়। রস থেকে তৈরিকৃত পাটালি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে। দেশের অন্য গুড়ের হাট থেকে এই হাটে ভালো মানের গুড় ও পাটালি এবং দামে তুলনামূলক কম থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানের গুড় ব্যবসায়ীরা এগুলো ক্রয় করে ঢাকা, বরিশাল, চট্রগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহীতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছে। কৃষি বিভাগের খেজুর গাছ রক্ষায় কোন ভুমিকা না থাকায়, খেজুর গাছের ক্ষেত উজাড় করা হয়েছে। এদিকে একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদনের জন্য খেজুরের ক্ষেত নষ্ট করে অন্য আবাদের দিকে ঝুকছেন চাষিরা। অথচ ৯০ দশকের দিকে শীত মৌসুমে এ শিল্পের কদর ছিল দেশ জুড়ে। কালীগঞ্জের-পাটালি মানেই শীত মৌসুমে অতিথিদের আগাম বায়না ধরা। সময় এলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা অতিথিদের জন্য কুরিয়ার অথবা অন্যান্য যোগে পাঠানোর পালা পড়ে যায় কালীগঞ্জ বাসির। গত ২ বছর ধরে জেলার কৃষি বিভাগ খেজুর গাছ ও ঐতিহ্যবাহী গুড়ের দিকে নজর দিয়েছে। কৃষকদের খেজুর গাছের চারা রোপণে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি প্রশিক্ষন দিচ্ছে। ঝিনাইদহ শহরতলীর নগরবাথান বাজারে রাসেল গ্লোবাল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ভাবে খেজুরের গুড় তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে সনাতন পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ নির্ভেজাল ভাবে খেজুরের গুড় তৈরি করা হচ্ছে।রাসেল গ্লোবাল লিমিটেডের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়ে এলাকার প্রায় ২৫০ জন চাষি নিরাপদ ও নির্ভেজাল গুড় তৈরি করছে। বর্তমানে তাদের নিজস্ব কারখানায় ১৬ জন শ্রমিকের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ কেজি গুড় তৈরি করা হচ্ছে। তাদের উৎপাদিত গুড়ের ৮০ ভাগ কারখানা থেকেই বিক্রি হয়ে যায়।শীত বাড়লে তাদের উৎপাদন আরও বাড়বে বলে জানান উদ্যোক্তা রাসেল আহমেদ।রাসেল গ্লোবাল লিমিটেড জেলার বিভিন্ন সড়কে ও পতিত জমিতে প্রায় ৩০ হাজার খেজুরের চারা রোপণ করেছে। কৃষি অধিদপ্তর, বারটান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিকার অধিদপ্তরের সহযোগিতায় প্রায় ৪ শতাধিক কৃষককে খেজুরের নিরাপদ রস ও গুড় উৎপাদনের প্রশিক্ষন দিয়েছেন। রাসেলের এই উদ্যোগের সাথে যোগ হয়েছেন আরও ৬ তরুণ। কিন্তু কারখানার দেখাশুনা করেন রাসেল একাই। তাদের কারখানায় এখন প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ লিটার রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। প্রতি ৬ লিটার রস থেকে এক কেজি গুড় তৈরি হয়।গত ২৭ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১০০ জন গাছীকে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছে।কালীগঞ্জ গুড়ের হাটের চাহিদা টা অনেকটা বেশি বিভিন্ন এলাকায়। অবশ্য এবছর বিগত বছরের তুলনায় এবার গুড় পাটালি অনেকটা কম উঠছে এ বারে দাম অনেকটা বেশি বলে কৃষক ও ব্যবসায়িরা জানান। কৃষকরা বলছে মাঠে আগের ন্যায় তেমন একটা খেজুর গাছ নেই যে কারণে গুড় ও রস উৎপাদন কম হচ্ছে। উপজেলার রামনগর গ্রামের মহিদুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, খেজুর গাছ থেকে ৮-৯ কলস (মাটির তৈরি) রশ পেলে মাটির এক কলস (৮-১০) কেজি ভাল গুড় হয়।কোটচাদপুর উপজেলার এলাঙ্গি গ্রামের জাহাঙ্গির আলম বলেন, তাদের গ্রামের উৎপাদিত খেজুরের গুড়ের ব্যাপক কদর রয়েছে দীর্ঘ বছর ধোরে। কালীগঞ্জ গুড়ের হাটের মালিক জানান, কালীগঞ্জের খেজুর রসের গুড় ব্যাপক প্রসিদ্ধ, এই কারণে গুড়ে কাঁচা রসের ঘ্রান পাওয়া যায় অনেক বেশি। কৃষকরা বলছেন গুড়ের ও রসের ভাড়ের দাম অনেক বেশি এবং গুড় তৈরির জালানি তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষকরা গুড় তৈরি করে আখের পাতা, বাশের পাতা, আম গাছের পাতা, পাটখড়ি দিয়ে, কিন্তু আগের মত রস জালানোর তেমন ভাতা পাওয়া যায় না। ঝিনাইদহ জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমানে ১ লাখ ৪০ হাজারের মত খেজুর গাছ রয়েছে। আমরা খেজুর গাছের চারা রোপণে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। খেজুর গাছের চারা রোপণকারী ও নিরাপদ গুড় উৎপাদনকারীদের পুরষ্কারের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।