তালহার জীবনে কোনো কিছু হঠাৎ আসে না। তার জীবন ছিল ঢেউহীন পুকুরের মতোÑএকঘেয়ে, নিশ্চুপ। সে ছিল চুপচাপ, বইপ্রেমিক, আকাশ দেখতে ভালোবাসত, কিন্তু বন্ধুদের আড্ডা, খেলা কিংবা প্রাণবন্ত জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বেশ দুর্বল।
কিন্তু সব কিছু বদলে গেল সেদিন, যখন সে গলির মোড়ে একটা কাঁপতে থাকা কুকুরছানাকে দেখতে পেল। ধুলো মাখা শরীর, কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটা ভয়ে কাঁপছে। তালহা থেমে গেল। তার বুকের ভিতর যেন হালকা একটা ধাক্কা লাগল।
সে নিচু হয়ে বলল, “তুই এখানে কিভাবে এলি, হ্যাঁ ছোট্ট পিচ্চি?’’
কুকুরটা কোনো শব্দ করল না, শুধু তাকিয়ে রইল। তালহা তার ব্যাগ থেকে একটা বিস্কুট বের করে সামনে রাখল। কুকুরটা শুকনো জিভে একটু চেটে দেখল, তারপর খেতে শুরু করল।
সেই মুহূর্তে, তালহা জানত না, তার জীবনের গতিপথ বদলে যাচ্ছে।
“মা, দেখো আমি কাকে এনেছি!’’
মা প্রথমে চমকে উঠলেন। “এই! পাগল হয়েছিস? কুকুর ঘরে এনে ফেলেছিস?
তালহা অনুনয় করে বলল, “একটু রাখতে দাও না মা। বাইরে ও মরেই যেত। দেখো না কতটুকু ছোট!’’
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “একদিনের জন্য রাখ। কাল না হয় ছেড়ে দিবি আবার।”
কিন্তু সেই ‘একদিন’ আর ফুরোল না।
তালহা তার নতুন বন্ধুর নাম রাখল ‘টোটো’। টোটো দিনে দিনে তার ছায়া হয়ে উঠল। স্কুল থেকে ফেরার পরে দরজা খুলে তাকিয়ে দেখত টোটো দাঁড়িয়ে আছে, লেজ নাড়াচ্ছে। সন্ধ্যাবেলায় যখন তালহা ছাদে উঠত, টোটো ঠিক তার পাশে বসে থাকত। আশ্চর্য, এতটা বোঝাপড়া, এতটা নির্ভরতা তালহা কোনো মানুষের কাছেও পায়নি।
টোটো শুধু কুকুর নয়, তালহার কাছে সে ছিল আশ্রয়। বন্ধু। আত্মার অংশ।
টোটোকে নিয়ে গল্প বানাত তালহাÑসে কিভাবে একদিন শহরের সেরা সারমেয় হয়ে উঠবে, কিভাবে একসাথে তারা পাহাড়ে যাবে, নদীর পাড়ে দৌড়াবে।
কিন্তু জীবন তো গল্প নয়, আর গল্পগুলোও সবসময় মধুর হয় না।
তালহা তখন অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। একদিন সন্ধ্যায়, পরীক্ষার চাপ থেকে একটু স্বস্তি পেতে তালহা টোটোকে নিয়ে গেল পাশের ফাঁকা মাঠে। কয়েকজন ছেলেমেয়ে সেখানে আগে থেকেই খেলছিল। তালহা আর টোটো খেলতে শুরু করল, কিন্তু আচমকা পাশ দিয়ে একটা মোটরসাইকেল দ্রুত চলে গেল, বিকট শব্দ তুলে।
টোটো ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাল।
“টোটো!” তালহা চিৎকার করে উঠল। দৌড় শুরু করল, ছুটে গেল পাশের গলি, রাস্তা, দোকানের পেছনের মাঠেÑকিন্তু কোথাও নেই।
তালহা ভেবেছিলÑঅন্ধকারের আগে ঠিক পেয়ে যাবে। কিন্তু রাত নামল। শহরের আলো নিভে গেল একে একে। আর টোটোর কোনো খোঁজ মিলল না। সেই রাতটা তালহার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ রাত ছিল। ভোরে উঠে সে আবার খুঁজতে বের হল। এই বাড়ি, সেই দোকান, পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে জিজ্ঞেস করলÑ “একটা ছোট কুকুর দেখেছেন কি?” কেউ দেখেনি।
পরদিন স্কুলেও গেল না তালহা। টোটোর ছবি প্রিন্ট করে পোস্টার বানাল, গাছে, দেয়ালে, দোকানে লাগাল। কিছু বন্ধুও তার সঙ্গে যোগ দিলÑকেউ তাকে সান্ত্বনা দিল, কেউ চোখ নামিয়ে রাখল, কেউ আর আগ্রহ দেখাল না।
দিন পেরোল একে একে।
টোটো ছিল না।
তালহার রুম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। জানালার পাশের জায়গাটা ফাঁকা। কেবল ঘুমের ভেতর, তালহা হঠাৎ জেগে উঠে শোনার চেষ্টা করতÑকোনো চেনা শব্দ কি আসছে? কোনো পায়ের ধ্বনি?
না।
সে একবার স্বপ্নে দেখল, টোটো দৌড়ে এসে ওর কোলে লাফিয়ে পড়ছে। তালহা জেগে উঠে ছুটে গেল দরজার দিকে। কিন্তু বাইরে কেবল ভোরের শীতল বাতাস।
একদিন, তিন সপ্তাহ পর, তালহা খুব ভেঙে পড়ল।
বৃষ্টির বিকেল। বইয়ের পাতাগুলোও ভেজা যেন তার চোখের জলের মতো। সে ডায়েরির পাতায় লিখলÑ
“টোটো, তুই যদি সত্যিই তোর মালিককে ভালোবাসিস, তবে ফিরে আয়। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি তোর তালহা।”
সে ডায়েরিটা খুলে রেখে জানালায় বসে থাকল অনেকক্ষণ। কিন্তু কিছুই ঘটল না।
সেই রাত, ৩টা বাজে। দরজায় খুব হালকা শব্দÑঘেউ... ঘেউ...
তালহা প্রথমে ভেবেছিল সে হয়তো স্বপ্ন দেখছে। তারপর শব্দটা আবার এল। এবার একটু জোরে।
সে উঠে দরজা খুলল।
টোটো দাঁড়িয়ে আছে। ভেজা, ক্লান্ত, চোখে অপার বিস্ময়। গায়ে কিছু আঁচড়ের দাগ, পায়ে হালকা কাতরানো।
তালহার চোখ থেকে নেমে এল পানি। সে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “টোটো... তুই ফিরে এসেছিস?’’
টোটো ধীরে ধীরে কাছে এল, নাকটা গুঁজে দিল তালহার পায়ের কাছে।
এভাবে দুই বন্ধুর পুনর্মিলন হলোÑনিঃশব্দে, গভীরভাবে, ভালোবাসার ভাষায়।
পরে জানা গেল, টোটোকে মাঠ থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাশের এলাকার কুকুর-ধরা ট্রাক। ভুলক্রমে! স্থানীয় এক কুকুরপ্রেমী মহিলা কয়েকটি কুকুর মুক্ত করার পর বুঝতে পারেন, টোটো খুব ঘরপোষা, তাকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ঠিকানা জানতেন না। অবশেষে সে তালহার বাসার দিকেই ফিরে আসতে থাকলÑতাদের পুরনো পথ ধরে।
তালহা তখন বুঝেছিল, টোটো শুধু কুকুর নয়। সে এক আস্থা, এক ভালোবাসা, যা হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে।