পরিবার শিশুর জন্য বিদ্যালয়, প্রথম পাঠশালা। এখানে যা যা শিখবে, সন্তান সারাজীবন তাই-ই আমল করবে। মানুষ পারিবারিক শিক্ষার বাইরে খুব বেশিদূর যেতে পারে না। পরিবার থেকে পাওয়া শিক্ষার বিপরীতে জীবদ্দশায় মানুষের আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র এবং নীতি-নৈতিকতার আমূল রূপান্তর হয় না। শিশুর সামনে কেমন আচরণ করা হচ্ছে, প্রত্যেক বাবা-মায়ের তা সচেতনভাবে খেয়াল রাখা উচিত। এমনকি পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও যাতে শিশুদের সামনে কাঙ্ক্ষিত আচরণ করে, তা নিশ্চিত করা উচিত। যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক নেই, সন্তান পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণে সেটাই শিখবে। স্ত্রী যদি স্বামীকে সম্মান না করে, স্বামী যদি স্ত্রীকে মূল্যায়ন না করে, সন্তান তেমনটাই ধারণ করবে। সন্তান যেহেতু আসমান থেকে নাজিল হয় না, সুতরাং পারিপার্শ্বিকতার দ্বারাই তার মানস গঠন হয়। কাজেই দাম্পত্যের মান-অভিমান, ঝগড়াঝাঁটি, এসব থেকে শিশুদের দূরত্বে রাখা উচিত। শিশুদের মতো এত বেশি অনুকরণপ্রবণ দ্বিতীয় কোনো সত্তা ধরাধামে নেই। সামর্থ্য থাকার পরও শিশুদের বেহিসাব খরচ করতে শেখানো উচিত নয়। অসামর্থ্য হওয়ার পরেও শিশুকে সকল অভাব বুঝতে দেওয়া ঠিক নয়। যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক মধুর, সে পরিবারের সন্তানের মানসিক বিকাশ স্বাভাবিকভাবে ঘটে। যেখানে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে কাজে সহায়তা করে, বিপদের সময় ভরসা হয়ে ছায়া দেয়, একজনের বিপদে সবাই এগিয়ে আসে এবং আড়ালেও পরস্পরকে সম্মান দিয়ে কথা বলে, সেখানের শিশুদের মানবিক গুণাবলি অর্জন সহজ হয় এবং চিন্তার পূর্ণতা লাভ করে। পরিবারের মধ্যে শিশুদের লিঙ্গবৈষম্য করা চরম আত্মঘাতী কাজ। ছেলে-মেয়েকে সমান চোখে দেখতে হবে। এমনকি বেশি উদারতা দেখাতে গিয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। মোটকথা, কেউ যাতে তার অবস্থানে মানসিকভাবে অনিরাপদ বোধ না করে। দামি খাবার এককভাবে সন্তানকে খাওয়ানো, ‘‘আমার সন্তান মুরগির থাই ছাড়া খায় না’’, এসব শেখানো বাবা-মায়েদের শেষ বয়সে দুর্ভোগের শেষ থাকে না। সন্তানকে অভাব কিংবা প্রাচুর্যের মধ্যেও সামাজিকতা শেখাতে হবে। রাতের জন্য সামান্য খাবার থাকলে বাবা-মা উপোস থেকে সন্তানের পাতে তুলে দেওয়ার রেওয়াজ আছে, যা চরম আত্মঘাতী। ভাগাভাগি করে খেতে হবে। এক-দুই বেলা না খেলে কেউ মারা যায় না। এই ভাগাভাগির রীতি সন্তানকে সহমর্মিতা ও সহনশীলতা শেখাবে। দানের অভ্যাস গড়তে সন্তানদের সামনে এবং তাদের হাত দিয়ে দান-সদকা করাতে হবে। নিয়ম করে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে। শিক্ষা বা চাকরির অজুহাতে কিংবা সামাজিক অবস্থান বিচার করে অনেকেই সন্তানদের গরিব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিশতে দেন না। সন্তান বাজে শব্দ শিখবে, এমন অজুহাতে অনেকে তাদের পাড়াপ্রতিবেশীর সন্তানদের সঙ্গে খেলতে দিতে চান না। এটা ঠিক নয়। অশ্লীল শব্দ যে কদর্য ব্যাপার, তা শিশুরা ছোটবেলাতেই শিখলে শুদ্ধ হওয়া সহজ হবে। বয়সের স্তরের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের উপযুক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সন্তানকে ভালো-মন্দের পার্থক্য শেখানোর দায়িত্ব অভিভাবকদের। তবে পছন্দ-অপছন্দ করার স্বাধীনতাও থাকা উচিত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, অথচ সন্তানের পোশাক পছন্দ করে দেওয়ার দায়িত্ব বাবা-মা, বিশেষ করে মা, ভালোবাসার অধিকার হিসেবে রাখেন, এটি ভুল সিদ্ধান্ত। বন্ধুত্ব স্থাপনের ক্ষেত্রে উত্তম-অধম বোঝানো যায়, কিন্তু হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। বাবা-মা যেমনই হোক, প্রায় সব সন্তানের কাছেই তারা শ্রেষ্ঠ আদর্শস্বরূপ। সন্তানের সামনে কখনো অশ্লীল কথা বা চরিত্রের নেতিবাচক দিক প্রকাশ করা উচিত নয়। যতটা সম্ভব চাদরে আবৃত থাকুন, এমনকি দাম্পত্যের আদরও। সন্তানকে শুধু শাসন করে বা নজরদারিতে রেখে মানুষ করা সম্ভব নয়; বন্ধুত্বের স্পর্শ থাকা দরকার। পরিবার থেকেই বড়দের সম্মান করা এবং ছোটদের স্নেহ করার পাঠ দিতে হবে। ধন্যবাদ দেওয়ার অভ্যাস ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের রেওয়াজ, সন্তান পরিবার থেকে না শিখলে দুনিয়ার আর কোথাও থেকে তা শেখার সুযোগ পাবে না। সন্তানের মানুষ হওয়ার দৌড় মূলত পরিবার নামক পাঠশালা থেকেই শুরু হয়। সফল হওয়া, চাকরি পাওয়া, এসবের শিকড় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হলেও, মানুষ হওয়ার শিক্ষা আসে পরিবার ও সবচেয়ে কাছের মানুষদের কাছ থেকে। পরিবারের মতো কার্যকর পাঠশালা দ্বিতীয়টি নেই। বড় চাকরি পাওয়া, নামকরা কবি-সাহিত্যিক হওয়া আর সত্যিকারের বড় মানুষ হওয়া এক কথা নয়। মনুষ্যত্বের বীজ পরিবার থেকেই বপিত হয়। ছোট্ট শিশু বাবাকে যেমন আচরণ করতে দেখে, মাকে যেভাবে কথা বলতে দেখে, সেভাবেই আচরণ করতে ও বলতে শেখে। বাজে পরিবার থেকেও দু-একটি পদ্মফুলের জন্ম হয় বটে, তবে বিচ্ছিন্ন উদাহরণকে নিয়ম ধরে নেওয়া যাবে না। সাধারণত একজন মানুষ শৈশবে যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তার চরিত্র ও মানসিকতা অনেকাংশেই তার প্রতিফলন হয়। সুতরাং মা-বাবাকে অত্যন্ত সচেতন হতে হবে। গুড প্যারেন্টিংও অন্য যে কোনো দক্ষতার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এখানে ব্যর্থ হওয়া মানেই একটি ব্যর্থ প্রজন্মের পূর্বসূরির দায় বহন করা। ভালো বাবা-মা হওয়ার জন্য পরিবারে ইতিবাচক পরিবেশ বজায় রাখাই মুখ্য। যেহেতু বর্তমানে বেশিরভাগ পরিবার একক পরিবার, তাই বাবা-মায়ের হাতেই একটি শিশু পুতুলের মতো গড়ে ওঠে। অভিভাবক সন্তানের মানসিকতা ও চিন্তাকে যেভাবে রূপান্তরিত করবে, সন্তানের মনও ঠিক সেভাবেই গঠিত হবে।
লেখক: রাজু আহমেদ; প্রাবন্ধিক