ফিলিস্তিনের ইসরায়েলের গণহত্যা, ভারতে মুসলমান হত্যা বিশ্ব মানবতার জন্য কলঙ্ক

মো. হায়দার আলী : | প্রকাশ: ২৪ মার্চ, ২০২৫, ০৭:৩৯ পিএম
ফিলিস্তিনের ইসরায়েলের গণহত্যা, ভারতে মুসলমান হত্যা বিশ্ব মানবতার জন্য কলঙ্ক
মো. হায়দার আলী

যুদ্ধবিরতির দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা উপেক্ষা করে গাজায় নজিরবিহীন বর্বরতা চালাচ্ছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। পনেরো মাসের বিরতিহীন বোমা হামলায় গাজাকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পুরো উপত্যকার প্রায় সব অধিবাসীকে বাস্তুচ্যুত, ৪৯ হাজারের বেশি হত্যা ও লক্ষাধিক আহত করার পরও ইহুদি রাষ্ট্রের বর্বর বাহিনী একজন জিম্মিকেও হামাসের কাছ থেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে জানুয়ারিতে একটি যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হয়েছিল। চুক্তি মোতাবেক প্রথম স্তরের যুদ্ধবিরতিতে অন্তত ৩৩ জন ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তির বিনিময়ে ২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু উগ্রবাদী ইহুদিরা এই যুদ্ধ বিরতিকে হামাসের কাছে ইসরাইলের কৌশলগত পরাজয় হিসেবে দেখেছে। তারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গাজায় হামলা ও শিশুহত্যা অব্যাহত রাখার পক্ষেই সাফাই গাইছিল। এর আগে যুদ্ধের শুরুতেই কেউ কেউ গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার দাবিও করেছিল। ধারণা করা যায়, জিম্মিদের ফিরিয়ে নিতে ইসরাইলের আভ্যন্তরীণ চাপ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের আগেই হামাস-ইসরাইল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। প্রতিদিনের ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকা- বন্ধ করে বন্দিবিনিময় ও শান্তির উদ্যোগে গোটা দুনিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু জায়নবাদী বর্বর ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনি ও আরব প্রতিবেশীদের শান্তিতে বাস করতে দিতে নারাজ। ঠুনকো অজুহাত তুলে তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে সরে গিয়ে প্রথমে গাজায় মানবিক সহায়তা বন্ধ করে সেখানকার বাস্তুহীন, বিপর্যস্ত অধিবাসীদের মানবিক বির্পযয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে তাদের উপর টার্গেট কিলিং শুরু করেছে। গত মঙ্গল ও বুধবার ৪৮ ঘণ্টার বিমান হামলায় গাজার আশ্রয় শিবিরগুলোতে প্রায় ১ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী ও শিশু।

অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল সাড়ে ৭ দশক ধরে ফিলিস্তিনি ও আরব প্রতিবেশীদের উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। আর এসব আগ্রাসন, ভূমিদখল এবং যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ সাবেক ঔপনিবেশিক ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সরাসরি যুক্ত। গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে গাজা দখল করে সেখানে রিভেরা বা প্রমোদ নগরী নির্মাণ ও মার্কিন মালিকানা প্রতিষ্ঠার খায়েশ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এই উদ্ভট অমানবিক প্রস্তাব সর্বমহলে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর মিশরের প্রস্তাবে গাজা পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের জন্য একটি ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা নিয়ে আরব বিশ্ব সম্মত হয়। যুদ্ধবিরতি এগিয়ে নিতে কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় আলোচনা এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই ইসরাইল গাজায় নতুন করে ভয়াবহ বিমান হামলা শুরু করে। হামাস নির্মূল ও গাজাকে ইসরাইলের জন্য নিরাপদ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা এখানকার নারী ও শিশুদের নির্বিচার গণহত্যায় মেতে উঠেছে। পনেরো মাসের যুদ্ধে বিধ্বস্ত জনপদে মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন একটি অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীর উপর এমন নির্মম বর্বরতা ইতিহাসে নজিরবিহীন।

ইহুদিদের এই বর্বরতার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদত স্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মদতে যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু গণহত্যা চালিয়ে গাজাকে জনশূন্য করে তা দখল করে নিতে চাইছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বর্বরতার নীরব দর্শকে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘ, ওআইসি, আরবলীগসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের নিরবতা-নিষ্ক্রিয়তায় বর্বররা শিশুহত্যায় মেতে উঠেছে। এটা যেন সেই ফেরাউন শাসনামল যখন বর্বর শাসক নিজের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করার লক্ষ্যে রাজ্যের সব শিশুপুত্র হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। এ যেন সেই আরবের অন্ধকার যুগ, যখন মেয়ে শিশুদের জীবন্ত কবর দেয়া হতো। বলা বাহুল্য, ইহুদিরা ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদের হত্যা করে ভবিষ্যতের প্রতিরোধ শক্তিকে নির্মূল করতে চায়।

পনেরো মাস ধরে গাজায় বিমান হামলা করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পাশাপাশি ব্যাপক আকারে স্থল অভিযান চালিয়েও হামাসের প্রতিরোধ শক্তি ও টানেল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা যায়নি। একজন জিম্মিকেও মুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর হামাসের সাথে যুদ্ধ বিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে ইসরাইল। পরাজয়ের এই গ্লানি থেকেই ট্রাম্প-নেতানিয়াহু উন্মাদের মতো গাজার শিশু হত্যায় মেতে উঠেছে। আইডিএফ’র বর্বরতায় সারা বিশ্ব স্তম্ভিত। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার ইহুদিও ইসরাইলি বর্বরতা বন্ধ ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে। গাজায় নতুন করে ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তীব্র প্রতিবাদ জানালেও দেশের মূল ধারার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের নিরবতা বিস্ময়কর। তবে অন্যান্য ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে যথেষ্ট সোচ্চার দেখা গেছে। 

ফিলিস্তিনে বর্বর ইসরাইলি হামলায় গণহত্যার প্রতিবাদে গত শুক্রবারবাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সন্ত্রাসী ইসরাইলি নেতানিয়াহুর ফাঁসির দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আজ রাজপথে ফেটে পড়েন। ইসরাইলি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ঢাকা মহানগরী আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হক ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের শাহাদাতের বদলা নেওয়ার আমরা শপথ নিচ্ছি। তিনি জাতিসংঘকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আপনাদের স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধের দাবানল সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আরব লীগ ওআইসিকে ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করতে কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিতে হবে। ফিলিস্তিনি-গাজায় মুসলিম হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য বাংলাদেশ থেকে মুজাহিদদের ডাক দিন। তিনি বলেন, মাহে রমজানে ভারতের মুসলমানদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। আওরঙ্গজেবের সমাধিতে একটি আঘাত করা হলে ভারত খান খান হয়ে যাবে। প্রয়োজনে আওরঙ্গজেবের সমাধি রক্ষায় ভারত অভিমুখে লংমার্চ করা হবে। তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, নীরব দর্শকের ভূমিকা এদেশের মানুষ দেখতে চায় না। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানান। ভারত সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিবাদ জানাতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে ফিলিস্তিনি ও ভারতের মুসলমানদের রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে।

আল্লামা মামুনুল হক বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতের দালালি করে আমাদের পাসপোর্ট থেকে এক্সসেপ্ট ইসরাইল লেখা তুলে দিয়েছে। বিশ্ব সন্ত্রাসী ইসরাইলকে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে অবিলম্বে বাংলাদেশের পাসপোর্টের এক্সসেপ্ট ইসরাইল পুনর্বহাল করতে হবে। লেডি ফেরাউন হাসিনার আমলে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড, মোদির আগমনের প্রতিবাদে হত্যাকাণ্ড এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন আগুন নিয়ে খেলবেন না। আওয়ামী লীগ এদেশের রাজনীতিতে আসতে হলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, সকল খুনিদের দ্রুত বিচার করুন। আর কোনো ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের ঠাঁই এদেশের মাটিতে হবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার যেকোনো ষড়যন্ত্র হেফাজতে ইসলাম দেশবাসীকে নিয়ে প্রতিহত করবে ইনশাআল্লাহ।

সংগঠনের ঢাকা মহানগরী সভাপতি মাওলানা জুনাইদ আল হাবিবের সভাপতিত্বে এবং মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনের সঞ্চালনায় এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, হেফাজতে ইসলামের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব, নায়েবে আমির মাওলানা আহমেদ আলী কাসেমী, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমী, মাওলানা মনির হোসেন কাসেমী, মাওলানা ফয়সাল মুফতি কামাল উদ্দিন।

নেতৃবৃন্দ বলেন, যে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি মুসলমানদের গণহত্যা বন্ধ করতে পারে না, সেই জাতিসংঘ দিয়ে কোনো লাভ নেই। অবিলম্বে মুসলিম জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইসরাইলি সকল পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। যে সব ব্যবসায়ীরা ইসরাইলের দালালি করবে তাদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। নেতৃবৃন্দ বলেন, কারো কারো অন্তরে আওয়ামী প্রেম দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদী ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে যারা পুনর্বাসনের স্বপ্ন দেখছেন তাদেরকেও এদেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে ইনশাআল্লাহ। ইসরাইলের নেতানিয়াহু, ভারতের মোদি, আর ফ্যাসিস্ট হাসিনা একই সূত্রে গাঁথা।

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা আর ভারতে মুসলিম নির্যাতন একই সূত্রে গাঁথা। ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানদের ওপর ইসরাইলির চালানো বর্বর গণহত্যা বিশ্ব মানবতার জন্য কলঙ্ক। শুধুমাত্র আরব বিশ্ব নয়, মানবতার পৃথিবী তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি নৃশংসতার প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আজ বাদ জুমা বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ইসরাইলি বর্বরোচিত হামলা ও মুসলিম গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমেরিকার উসকানিতে সন্ত্রাসী ইসরাইল ফিলিস্তিনের নির্বিচারে হত্যা করছে। ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে অনতিবিলম্বে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।

শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদের ঝড় অব্যাহতভাবে চলছে। নতুন করে হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন নানা দেশের মানুষ। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলের নৃশংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে পাকিস্তান, ইরাক, জর্ডান ও ইন্দোনেশিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে পর্তুগালে। গত বুধবার বিকেলে লিসবনের ঐতিহাসিক রসিও স্কয়ারে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। 

মানবাধিকার সংগঠন মুভিমেন্টো পেলোস ডিরেইটোস দো পোভো প্যালেস্টিনো এ পেলা পাজ নো মেডিও ওরিয়েন্টে (এমপিপিএম)-এর নেতৃত্বে এই সমাবেশে শত শত মানুষ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানাতে একত্রিত হন। 

গত ৪৮ ঘণ্টায় গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত ও কয়েক শতাধিক আহত হওয়ার পর জাতিসংঘের জরুরি বিবৃতি প্রকাশিত হয়।

এমপিপিএম বলেছে, নিরপরাধ নাগরিক তথা শিশুদের ওপর হামলা মানবতাবিরোধী অপরাধ। পর্তুগাল ও বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দের অবশ্যই এই সহিংসতা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

রসিও স্কয়ারজুড়ে ফিলিস্তিনি পতাকা, হামলায় নিহতদের ছবি ও অস্ত্র বন্ধ কর, শান্তি চাই লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে উত্তাল হয় স্থানটি। বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিন মুক্ত কর, ইসরায়েলি বর্বরতা বন্ধ কর, স্লোগানে মুখরিত করেন স্কয়ার। 

এমপিপিএম-এর সমন্বায়ক জোসে অলিভেইরা ভাষণে বলেন, ইসরায়েল নিরপরাধ মানুষের ওপর বর্বর হামলা করছে, গাজার শিশুরা খাদ্য ও ওষুধের অভাবে মরছে, আর আমরা নীরব থাকব? পর্তুগাল সরকারকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি করতে হবে। সমাবেশে ইসরায়েলের সঙ্গে পর্তুগালের সামরিক চুক্তি বাতিল, ফিলিস্তিনে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি হস্তক্ষেপের দাবি তোলা হয়। 

এই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া স্থানীয় শিক্ষার্থী ক্রিস্টিনা ফেরেইরা বলেন, এটা আসলে গণহত্যা, আমরা শুধু ন্যায়বিচার চাই, মানবিকতার প্রশ্নে ইউরোপীয় নেতারা চুপ করে থাকতে পারেন না। জরুরি হস্তক্ষেপ নিতে হবে।

পর্তুগালের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে- ব্লক এস্কেরদা, লিব্রে, পিসিপি গত ৪৮ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদমাধ্যমে তাদের কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছে। এছাড়া তারা পর্তুগাল সরকারের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে গণহত্যা বন্ধে বল প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পর্তুগালের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। 

সমাবেশ শেষে ৩০ মার্চ ফিলিস্তিন দিবস উদ্যাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে ৩০ মার্চ লিসবনের মার্তিম মুনিজে পার্কে বিকেল ৪ টায় পোর্তোতে জার্দিম ইনফ্যান্টে ডি. হেনরিকে বিকেল ৪টায় এবং কোয়েম্ব্রাতে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। 

দূতাবাস ঘেরাও, পতাকায় আগুন

গাজায় ইসরায়েলের নির্মম হামলার প্রতিবাদে গতকাল বড় বিক্ষোভ হয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর মধ্যে রাজধানী ইসলামাবাদে ইসরায়েলের মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ঘেরাও করেন জামায়াত-ই-ইসলামি পাকিস্তানের (জেআই) সদস্য ও সমর্থকেরা। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কনস্যুেলট ঘেরাও করা হয়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতাকায় আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা।

রাজনৈতিক দল জেআইয়ের প্রধান নাইম-উর-রহমান বলেন, সারা বিশ্বের মতো পাকিস্তানও নিপীড়কদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। এর আগে জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মুনির আকরাম গাজায় ত্রাণসহায়তা প্রবেশ ও দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।

গাজায় হামলার প্রতিবাদে মধ্যপ্রাচ্যেও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। জর্ডানের রাজধানী আম্মানে গতকাল জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ করেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের হাতে জর্ডানের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের পতাকা দেখা যায়। ইসরায়েলবিরোধী নানা স্লোগান দেন তাঁরা। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে।

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বাইরে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে বিক্ষোভকারীদের হাতে ফিলিস্তিনের পতাকার পাশাপাশি ছিল নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পবিরোধী প্ল্যাকার্ড।

এদিকে গাজায় নতুন করে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গতকাল কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে পুতিনের ফোনালাপের পর ক্রেমলিন জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত নিরসনে এবং দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে প্রস্তুত রাশিয়া ও কাতার। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে দেশটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বেসামরিক প্রত্যেক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করছে যুক্তরাজ্য।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তেল আবিবে বিক্ষোভ করেছে হাজারো মানুষ। ইসরায়েল সরকারের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত নিরাপত্তা পরিষেবার প্রধানকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত এবং গাজায় পুনরায় যুদ্ধ শুরুর প্রতিবাদে শনিবার (২২ মার্চ) রাস্তায় নেমেছে তারা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।

তেল আবিবের হাবিমা স্কয়ারে বিক্ষোভকারীরা নীল-সাদা ইসরায়েলি পতাকা নেড়ে গাজায় আটক থাকা অবশিষ্ট বন্দীদের মুক্তির জন্য একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির আহ্বান জানিয়েছে।

বিক্ষোভ থেকে ৬৩ বছর বয়সী মোশে হাহারোনি ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘ইসরায়েলের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু হলো বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি ২০ বছর ধরে দেশের কথা ভাবেন না, নাগরিকদের কথা ভাবেন না।’ গত শনিবারের সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা পোস্টার হাতে মিছিল করেছেন। পোস্টারে লেখা ছিল, ‘আর রক্তপাত নয়,’ ‘আর কত রক্ত ঝরবে?’ এবং ‘যুদ্ধ বন্ধ করুন, এখনই!’ যাতে করে গাজায় বন্দি থাকা ৫৯ জনকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চায় বিক্ষোভকারীরা। 

গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চায় বিক্ষোভকারীরা। গত রোববারও ইসরায়েলের সংসদ এবং পশ্চিম জেরুজালেমে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

৪৪ বছর বয়সী বিক্ষোভকারী এরেজ বারমান রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা দেড় বছর ধরে গাজায় তীব্র লড়াই দেখেছি, কিন্তু হামাস এখনও ক্ষমতায় রয়েছে। এখনও তাদের হাজার হাজার যোদ্ধা রয়েছে, তাই ইসরায়েলি সরকার প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের নিজস্ব লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।’যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ায়, বন্দীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে ২৪ জন এখনও জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা বলছেন, যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তারা হয় তাদের বন্দীদের হাতে মারা যাবে অথবা ইসরায়েলি হামলায় নিহত হবে।

এদিকে নেতানিয়াহু এই সপ্তাহে বলেছেন যে, তিনি ২০২১ সাল থেকে শিন বেতের নেতৃত্বে থাকা রোনেন বারে’র প্রতি আস্থা হারিয়েছেন এবং তাকে ১০ এপ্রিল থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়েছে। 

মানবতাবিরোধী ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শান্তিকামী বিশ্বের সম্মিলিত সামরিক-অর্থনৈতিক, বিচারিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর জীবন রক্ষায় বিশ্বসম্প্রদায়কে এক্ষুনি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে এ সংকটের সমাধান করতে হবে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে গাজায় মানবিক সহায়তা নির্বিঘ্ন করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : মোঃ হায়দার আলী; প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW