চিকিৎসায় আস্থা সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগের অভাবে কমছে না দেশীয় রোগীদের বিদেশগামীতা। বরং দিন দিন বাড়ছে। চিকিৎসা খাতে প্রতি বছর দেশ থেকে চলে যাচ্ছে বিপুল টাকা। কিন্তু এখনো সরকার থেকে কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। বরং স্বাস্থ্য খাতকে বিদেশনির্ভর করে ফেলা হয়েছে। যদিও দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারত ভিসা সীমিত করায় দেশের রোগীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটা কমেছে। বাধ্য হয়ে অনেক রোগী এখন চিকিৎসা নিচ্ছে দেশেই। স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে উন্নতমানের হাসপাতাল তৈরি ও চিকিৎসাসেবার সক্ষমতা বাড়ানো হলে দেশের রোগীদের বিদেশমুখিতা কমতো। সাশ্রয় হতো বিপুল টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে বিদেশে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিরা বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে বেসরকারি হিসাব মতে ওই খরচ আরো অনেক বেশি। কারণ বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার অর্থের ন্যূনতমও ব্যাংকের মাধ্যমে যায় না। অনেকেই মানি এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে। ব্যাংক থেকে নিলে ওই হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে থাকলেও মানি এক্সচেঞ্জারগুলো সঠিক হিসাব না দিলে তা থাকছে না। তাছাড়া মানুষ এনডোর্স করা অর্থের বেশি নিয়ে যায়। বাস্তবে বিদেশে চিকিৎসা ব্যয় সরকারি হিসাবের কয়েক গুণ বেশিই হবে। যদিও দেশে এখনো বিদেশে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়গুলোকে চিহ্নিত করার মতো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়গুলোর কোনো হিসাব ব্যাংকের কাছে থাকে না। আবার এসংক্রান্ত অনুমোদনের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বেশ জটিল। ফলে অনেকেই কালোবাজার, মানি এক্সচেঞ্জার বা অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে ডলার সংগ্রহ করন। তাতে আরো শক্তিশালী হচ্ছে অবৈধ হুন্ডির বাজার।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি ভারতের ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই সময় স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মেডিক্যাল হাব হিসেবে গড়ে তোলার। তবে বিশ্বমানের হাসপাতাল তৈরির সুযোগ বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তা স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সামর্থ্য বাড়ানো ও সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করছে। মূলত বাংলাদেশে চিকিৎসার খরচ বেশি, রোগ নির্ণয় যথাযথ না হওয়া, চিকিৎসকরা রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে না শোনা এবং অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়ার কারণে দেশের চিকিৎসায় রোগীর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। আর বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে বিদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার কিছু পার্থক্য রয়েছে। বিদেশে ডায়াগনোসিস (রোগ নির্ণয়) ভালো, ডাক্তাররা রোগীদের সমস্যার কথা সময় নিয়ে শোনেন, আচরণ ভালো। বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থায় ওসবের পরিবর্তন আনতে পারলে রোগীরা বিদেশমুখী হবে না।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কতজন মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায় তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। কারণ শুধু বিদেশে অস্ত্রোপচার করাতে চিকিৎসা ভিসা অপরিহার্য। তাছাড়া মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ, চিকিৎসার যাবতীয় কাগজ জমা দেয়ার প্রসঙ্গ থাকায় অনেকে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে চার লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০ জন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি। তাছাড়া এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের যেসব দেশ থেকে বেশি রোগী চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে যায় তার মধ্যেও রয়েছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশমুখী রোগীদের ৫১ শতাংশ ভারতে যায়। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে যায় ২০ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে রোগী যাওয়ার হার ৩ শতাংশ। ২ শতাংশ যায় জাপান ও মালয়েশিয়ায় আর ১ শতাংশ করে চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যায়। আরেক গবেষণার তথ্যানুযায়ী ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়াদের মধ্যে তালিকায় প্রথমে আছেন ব্যবসায়ীরা, দ্বিতীয় স্থানে বেসরকারি চাকরিজীবীরা, তৃতীয় স্থানে দিনমজুররা। তারপর রয়েছেন সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, গৃহিণী, চিকিৎসক। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষার্থী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য।
এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশে মানুষ মূলত চেকআপের জন্য বেশি যায়। তবে ভারতে ২০টির বেশি কারণে বাংলাদেশি রোগীরা চিকিৎসা নিতে যায়। তার মধ্যে রয়েছে হৃদযন্ত্রসংশিষ্ট ও চোখের ছানিজনিত অস্ত্রোপচার। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে যথাক্রমে কিডনি রোগ ও ক্যান্সার চিকিৎসা। বেশির ভাগই জটিল ও গুরুতর রোগের কারণে রোগীরা বিদেশে যাচ্ছে। সরকারি পর্যায়ে মানসম্পন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলে জটিল রোগের হার কমে আসবে। একই সঙ্গে রোগীদের বিদেশমুখী প্রবণতাও কম আসবে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে পুঁজির বিনিয়োগ ঠিকমতো হয়নি। বিনিয়োগ ঢাকাকেন্দ্রিক হয়েছে। দেশের ৯৫ শতাংশ অস্ত্রোপচার ঢাকায় হয়। সারা দেশে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা থাকলে পরিস্থিতি এমন হতো না। যেহেতু দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য নয়, অনেকে শুরুতে চিকিৎসা করাতে চান না। যখন পরিস্থিতি বেগতিক হয় তখন জায়গাজমি বেচে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। কারণ বিদেশের তুলনায় দেশের পাঁচতারা হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি।
অন্যদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি উল্টরণ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই প্রবণতা কমাতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এর সুফল মাত্র ছয় মাসে পাওয়া সম্ভব নয়। মূলত চারটি সমস্যা নিয়ে রোগীরা বেশি বিদেশি যাচ্ছে। এর মধ্যে ক্যান্সার সমস্যা, অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও হার্টের রোগ অন্যতম। দেশে হার্টের চিকিৎসায় ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। অন্যগুলোর উন্নতিতে দু-তিন বছর সময় লাগবে। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুরু করেছে। মানুষ যে যে কারণে বিদেশে যায়, সেগুলো চিহ্নিত করে বাংলাদেশে বিশেষায়িত হাসপাতাল অথবা বিএমইউ (বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) যেখানে যেটা প্রযোজ্য, সে জায়গায় অবকাঠামো ও জনবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু করেছে। এগুলোর ফল পেতে সময় লাগবে।