গুমের শিকার ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গুম’ ঘোষণা করার আইনি পথ খুলে দিল উপদেষ্টা পরিষদ। একই সঙ্গে দেশের হাওর ও জলাভূমি সংরক্ষণে নতুন অধ্যাদেশ এবং সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে বাংলাদেশের নতুন দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এই বৈঠকে মানবাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা এবং কূটনৈতিক সম্প্রসারণ নিয়ে একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
বার্তায় বলা হয়, গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি টানা অন্যূনতম পাঁচ বছর গুম থাকার পর জীবিত ফিরে না এলে সংশ্লিষ্ট ট্রাইবুনাল তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ডিসাপিয়ার্ড’ বা ‘গুম’ ঘোষণা করতে পারবে।
সংশোধিত বিধানে আরও বলা হয়েছে, মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার ট্রাইবুনাল’-এর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দিতে পারবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগী বা অভিযোগকারী ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ট্রাইবুনালে আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ পাবেন। গুম হওয়া ব্যক্তির স্ত্রী বা তাঁর ওপর নির্ভরশীল পরিবারের কোনো সদস্য কমিশনের পূর্বানুমতি ছাড়াই ওই ব্যক্তির সম্পত্তি ব্যবহার করতে পারবেন বলেও অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।
একই বৈঠকে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি সংরক্ষণ অধ্যাদেশ ২০২৫ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। উপদেষ্টা পরিষদ জানায়, হাওর অঞ্চলের ইকোসিস্টেম বিশ্বে বিরল ও অনন্য হলেও অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, বিষ ও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং পর্যটনের বিরূপ প্রভাবে এই পরিবেশ ব্যবস্থা আজ হুমকির মুখে। এর পাশাপাশি জলাশয় রক্ষায় কার্যকর আইনি কাঠামোর অভাবও স্পষ্ট।
এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের দায়িত্ব, কর্তৃত্ব ও অধিক্ষেত্র স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হবে। হাওর ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারির বিধান রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সংরক্ষিত হাওর ও জলাভূমি এলাকা ঘোষণা, নিষিদ্ধ কার্যক্রম চিহ্নিত করা এবং এসব অপরাধের জন্য দণ্ডের ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অধ্যাদেশে আরও বলা হয়েছে, হাওর ও জলাভূমি এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ব্যতিক্রম ছাড়া সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক হবে। প্রয়োজনে অন্যান্য দপ্তর ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়, স্থানীয় অংশীজনদের সম্পৃক্ততা এবং সংরক্ষণ কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিধি ও নির্দেশিকা প্রণয়নের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে বাংলাদেশের নতুন একটি দূতাবাস স্থাপনের প্রস্তাবও অনুমোদন পায়। স্বাধীনতার পর থেকেই জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন থাকলেও বার্নে দূতাবাস না থাকায় এতদিন সেখান থেকেই জাতিসংঘ ও কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী ও কৌশলগত অংশীদার হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। প্রাথমিকভাবে একজন রাষ্ট্রদূত, একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা কর্মচারী দিয়ে দূতাবাসের কার্যক্রম শুরু হবে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মোট ৮২টি মিশন অফিস রয়েছে।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থাও আলোচনায় আসে। বার্তায় জানানো হয়, তাঁর অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান নিয়মিতভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাঁর চিকিৎসার খোঁজখবর নিচ্ছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুরে পৌঁছে সরাসরি চিকিৎসা তদারক করছেন।
এ ছাড়া এবছর মহান বিজয় দিবস সুন্দর ও সুচারুভাবে উদযাপনের জন্য মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।