পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে সব চেয়ে বেশী দেখা মেলে হরিণের। মায়া ও চিত্রা নামের দুই প্রজাতির হরিণ দেখা যায় এ বনে। তবে এর মধ্যে চিত্রা হরিণের সংখ্যাই বেশী। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্যা কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) জরিপের তথ্য মতে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪ টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার। তবে জরিপে হরিণের সংখ্যা বাড়লেও সুন্দরবনে শিকার বন্ধ হচ্ছে না। সারা বছরই হরিণ শিকার করে স্থানীয় চিহ্নিত চোরা শিকারীচক্র। ঈদকে সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ওই শিকারীচক্র গুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা জানায়, পেশাদার শিকারীরা সুন্দরবনে ঢুকে নাইলনের দড়ির ফাঁদ পেতে রাখেন। চলাচলের সময় হরিণ ওই ফাঁদে আটকে যায়। এ ক্ষেত্রে শিকারীরা জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার জালের সাথে দড়ি বহন করে বনে নিয়ে যায়। ওই দড়ি ফাঁদ তৈরীর কাজে ব্যবহার করে। শিকারীরা বনে বসেই মাংস কেটে লোকালয়ে এনে বিক্রি এবং চামড়া মাথাসহ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংরক্ষন করে সুবিধামত সময়ে পাচার করে থাকে। তারা বলেন সুন্দরবনে সারা বছরই হরিণ শিকার করে সংঘবদ্ধ চোরা শিকারীচক্র। সাম্প্রতিক সময়ে খুলনার নলিয়ান রেঞ্জের আওতায় দাকোপ ও কয়রা এলাকায় হরিণ শিকারীরা বেশ তৎপর। এ ক্ষেত্রে বনবিভাগের ভূমিকা নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঈদ পূজার মত সার্বজনীন বৃহৎ উৎসব আসলেই সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠে স্থানীয় চোরা শিকারীচক্র। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এজেডএম হাছানুর রহমান জানিয়েছেন, ঈদকে সামনে রেখে হরিণ শিকারসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনের সব কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের ছুটি বতিল করে কর্মস্থল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এবং পর্যটন এলাকা গুলোতে ইকোট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সার্বক্ষণিক টহল জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবন ও উপকুল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শুভ্র শচীন বলেন, সুন্দরবনে বাঘের প্রধান খাবার হরিণ শিকার হচ্ছে হরহামেশাই। তবে উৎসবে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা অপেক্ষাকৃত বেড়ে যায়। সাধারণত ধর্ণাঢ্যরা হরিণের মাংস দিয়ে উৎসব পালনে আগ্রহী হয়। ফলে বেপরোয়া হয়ে ওঠে স্থানীয় চোরা শিকারীচক্র। বনবিভাগ ও পুলিশ বলছে, আইনশৃংক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে আটক হরিণ শিকারীদের তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বেশী হরিণ শিকারের সাথে যুক্ত। সুন্দরবন প্রভাবিত বিশেষ করে খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্রামনগর এবং বাঘেরহাটের মোংলা ও শরনখোলার মানুষ বেশী হরিণ শিকারের সাথে জড়িত। এখানকার অধিকাংশ পরিবার সুন্দরবনকেন্দ্রীক পেশার সাথে সম্পৃক্ত। বনবিভাগ ও পুলিশ সুত্রে জানা যায়, চলতি বছর এ পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযানে ৭৫৭ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়েছে। এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৬টি। আসামী করা হয়েছে ৮৪ জনকে। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জব্দ করা হয়েছিলো ৫১৪ কেজি হরিণের মাংস। তবে জব্দ অপেক্ষা কয়েক গুন বেশী হরিণের মাংস ও চামড়া পাচার হয় এমন দাবী সুন্দরবন ও উপকুল সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী শুভ্র শচীনের। তিনি বলেন মাঝে মধ্যে অভিযানে কেউ কেউ আটক হলেও মূল শিকারী ও পাচারকারীরা থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে। অন্যদিকে আটককৃতরা দূর্বল আইনের সুযোগে কয়েকদিনের ব্যবধানে জেল থেকে বেরিয়ে আবারও শিকার এবং পাচারে জড়িয়ে পড়ে এমন দাবী তার।