ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দূর্গাপুর গ্রামে বসবাস করেন ৬৫ বছর বয়সী মনিমালা পাল। এ বয়সে জীবিকার তাগিদে পায়ে চালিত ভ্যানগাড়ি চালিয়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে বেড়ান তিনি। মাটির তৈরি নানা আসবাবপত্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করেন বৃদ্ধা মনিমালা। তিনি কখনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাননি। তাই শেষ বয়সে এসেও তাকে এতো কষ্ট করতে হচ্ছে। স্বামী আশুতোষ পাল ২১ বছর আগে মারা গেলে স্বামীর ভিটায় আর আশ্রয় হয়নি মনিমালা পালের। পরে একই গ্রামের গনেশ পালের দেওয়া একটি ঘরে সন্তানসহ আশ্রয় নেন মনিমালা। এখানে মাটির তৈরি নানা আসবাবপত্র পুড়িয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন তিনি।এভাবে কঠোর পরিশ্রম করে জমানো অর্থ দিয়ে মনিমালা পাল বিয়ে দিয়েছেন বড় মেয়ে অর্চনা পালকে। আর ছোট ছেলে সমীর পাল ভালোভাবে কথা বলতে না পারায় তাকে বাড়িতে রেখে দিয়েছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে গনেশ পালের বাড়িতে বসবাস করা মনিমালা পাল বাড়ির পাশে মাটির তৈরি আসবাবপত্র প্রস্তুতের চুলা তৈরি করেছেন। নিজ হাতের তৈরি মাটির এসব আসবাবপত্র প্রতিদিন ভ্যান গাড়িতে ফেরি করার উদ্দেশ্যে বের হন তিনি। মনিমালা পালের বাড়ির কাজে সহযোগিতা করেন তার ছেলে সমীর পাল। মনিমালা পাল বলেন,কত মানুষকে বলাম, আমার জন্য কেউ কিছু করলো নারে বাবা।আমি এ বয়সেও প্রতিদিন ভ্যানগাড়ি নিয়ে বিভিন্ন গ্রাম ঘুরি তার কোনো হিসাব নাই। সারাদিন ঘুরে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ইনকাম হয় আমার।মনিমালা পালের প্রতিবেশি অসীম ঘোষ বলেন, মনিমালার মত গরিব মানুষ আর হয়তো এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মনিমালা যদি সরকার থকে সুবিধা না পায়, তবে পাবে কে ? কাদা মাটি নিয়ে মাটির জিনিসপত্র বিক্রির কাজে ব্যস্ত থাকেন মনিমালা পাল। মাটির তৈরি জিনিস বিক্রি করেই চলে সংসার। পাতিল,গামলা,কুপি বাতি,থালা,দুধের পাত্র, ভাঁপাপিঠা তৈরির কাজে ব্যবহৃত খাঁজ, গরুর খাবার পাত্র, ধান-চাল রাখার বড় পাত্র, কড়াই, মাটির ব্যাংক, শিশুদের জন্য রকমারি নকশার পুতুল, খেলনা ও মাটির বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করেন তিনি।এ পেশায় জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। মৃতশিল্প তৈরির উপকরণ যেমন মাটি সঙ্কট ও খড়ির দাম বেশি হওয়ায় এর দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও কমেছে। অসহায় মনিমালা পাল বলেন, বাজারে আগের মত এখন আর মাটির জিনিস বিক্রি হয়না। তারপর কোন রকম কষ্ট করে সংসার চলছে।
একদিন মাল বিক্রি বন্ধ থাকলে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হয় তার পরিবারকে। অদম্য ইচ্ছার জোরে ভ্যান চালিয়ে সংসারের চাকা সচল রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত রোজগারে চলা একটা পরিবারের প্রধান হিসাবে মনিমালা সদস্যদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রায় ২৫ বছর ধরে ভ্যানে মাল বয়ে গ্রামগঞ্জে হাট-বাজারে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের মৃত আশুতোষ কুমার পালের স্ত্রী মনিমালার সংগ্রামি জীবনের কথা। নলডাঙ্গা দুর্গাপুরে ছেলে- বৌমার সঙ্গে পরের জমিতে ঘর করে থাকলেও মনিমালা কালীগঞ্জ পৌরসভার শিবনগর এলাকার একজন ভোটার। ২৫ বছর হলো স্বামীহারা হয়েছেন তিনি,তারপর থেকেই সংসারের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার ছেলেকে করিয়েছেন বিয়ে। নলডাঙ্গা বাজারের একটি ভাংড়ি দোকানের কাজ করে ছেলে একা সংসার চালাতে পারে না। যে কারণে মনিমালা ভ্যানে করে বিভিন্ন হাটে ও গ্রাম্য বাজারে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে থাকেন। শ্রমজীবি ষাটোর্ধ্ব মনিমালা বলেন, আমি একজন মহিলা মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করি। মাল বোঝাই ভ্যান টানতে খুব কষ্ট হয় আমার। কিন্তু অন্য কোনো উপায় যে নেই আর আমার হাতে। নিজের বলে কিছুই নেই; মাথাগোঁজার ঠাঁইও নেই আমার। শুধুমাত্র বিধবা ভাতা ছাড়া আর কোনো সরকারি সাহায্য সহযোগিতা আমি পাই না। হাট-বাজারে একটা স্থায়ী দোকান থাকলে আমাকে আর ভ্যান ঠেলে মাল বিক্রি করা লাগত না।প্রতিদিন বেলা ১০ টার দিকে বের হয়ে সন্ধায় বাড়ি ফেরেন শুক্রবার এবং সোমবার কালীগঞ্জের সাপ্তাহিক হাটের দিনে রাত ৯ টার পরে বাড়ি ফেরে যান।কালীগঞ্জ শহরে শুক্র ও শনিবার হাটের দিন, হাসপাতাল সড়কে, মুসলিম বেকারির সামনে, ফুটপাতের রাস্তায় এবং শনি ও মঙ্গলবার নলডাঙ্গা বাজারে মনিমালাকে মাটির তৈরি নানা রকম জিনিসপত্রের পরসা সাজিয়ে বসতে দেখা যায়আবার ভাটপাড়া,শিবনগর,আড়পাড়া,চাচড়া,আনন্দবাগ, পাইকপাড়া, জগন্নাথপুরসহ অনেক গ্রামে ভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে মাটির জিনিসপত্রও তিনি বিক্রি করে থাকেন। বৈরী আবহাওয়া কিংবা শরীরের ক্লান্তি সবকিছুকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন মনিমালা নিজেই মাটির তৈরি জিনিসপত্র বোঝাই ভ্যান টেনে বিক্রি করছেন। মাটির তৈরি ব্যাংক, হাড়ি, বাচ্চাদের খেলনার মতো ছোট ছোট জিনিসপত্র বাড়িতে বসে তিনি নিজেই তৈরি করে এবং ভাড়, মালসা, চাড়ির মতো মাটির তৈরি বড় জিনিসপত্র গুলো কিনে এনে বিক্রি করেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ইসলাম বলেন, ওনার ব্যাপারটা আমি জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখবো। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে।